সাম্প্রতিক সময়ের দুইজন সাহিত্য কর্মী কবিতার নানান দিক নিয়া একটা আলাপে বসেছেন। এই আলাপের সূচনাকারী বা সূত্রধর আর কথক দুইজনই বেশ আন্তরিকতা নিয়া আয়েশি চালে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় বা দরকারী মনে করেন -এমন সব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটা হঠাৎ বসে ঠিক করা, পরে লিখিতভাবে আপনাদের সামনে অক্ষর বা চিহ্ন মাধ্যমের বদৌলতে হাজির করা হচ্ছে। সূচনাকারীর প্রশ্ন ছোট হলেও জবাবের মধ্যে অনেক পথ ঘুরতে ঘুরতে প্রশ্ন খেয়ে ফেলতে হয়েছে অনেক সময়। ফলে আলাপ হয়েছে বহর ছাড়া। ধরা যাক, আলাপ করছেন সূত্রধর ও কথক।
আত্মরতির পদ্যভঙ্গি:
সূত্রধর : এই পর্বে আমাদের মূল আলাপের জায়গাটা হইলো, ‘স্বকীয়তা আর স্বতস্ফূর্ততার মধ্যে কোনটি গুরুত্বপূর্ণ? দুয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কী’? এইটা খুঁজে দেখতে দেখতে আমরা আরও কিছু খুচরা আলাপে প্রবেশ করব।
কথক : এইডা কি কইলেন? স্বীকয়তা কি জিনিস? আর স্বতস্ফুর্ততা কোন দিন কি দেখছেন? তার পরে আবার দুয়ের মধ্যে পার্থক্য – খাইসে আমারে, হা হা হা!
সূত্রধর: আপনে খালি তামাশা করেন! তামাশা না। তামাশা রাখেন পারলে জীবন করেন…?
কথক : জীবন করতে পারব না। প্রজ্ঞা ছাড়া নাকি জীবন হয় না-এমন কান্টিয় ধারণায় আমি আর আস্থা রাখতে পারি না। জীবনকে দেখবার ক্যাটাগরিক্যাল ধারণা জীবনের খোঁজ পায় নাই আজও। জীবন থাকে জীবনে। যেমন কবিতা থাকে কবিতায়। জীবন কি ‘জীবনে’র দেখা পায়? যাক মশকারি করার জন্য কথাগুলা কইতেছি না। আপনার প্রথম আলাপ থেকে নজর না সরাইলে, আমরা প্যাঁচাল পাইরা খুব সুবিধা করতে পারব না। এই যে ‘স্বকীয়তা’ এইযে ‘স্বতস্ফূর্ততা’ এইসব ধারণা আমাদের মাথায় কেমনে ঢুকল? এগুলা কই থেকে আসল? এর সাথে লেখা-লেখির কি কোন সম্পর্ক আছে? এর সাথে কবিতার কি কোন সম্পর্ক আছে? আপনার আলাপের ইশারা ধরে অন্য দিকে চলে যাবো। ফাঁকে বলে নেই কবিতা নিয়ে আমাদের এখানে যে তরিকায় বা পদ্ধতিতে আলোচনা করা হয় তা নিয়া আমার গভীর আপত্তি আছে। আমাদের ভাবতে হবে কবিতার আলোচনা কি ভাবে আসলে সম্ভব? কবিতা নিয়া আমরা কি ভাবে কথা বলব? কি তরিকায় কথা বললে কবিতার ‘কথা’ আসলে বলা সম্ভব তা নিয়ে গোড়া থেকে ভাবনার দরকার আছে।
আমরা এই আলাপের মাধ্যমে উভয়ের জবানে কিছু দরকারি জিনিস ভাষায় আশা করি ধরতে পারব। নাহ কথাটা ঠিক হলো না। আমরা কথা বলছি ভাষা, শব্দ, বাক্য, ইশারা-ইঙ্গিত এবং নৈশব্দসহযোগে। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখা দরকার ভাষা শুধু প্রকাশই করে না লুকায়ও। আমরা লজিক্যাল বা বাইনারী স্টাইল এড়ানোর জন্য আলাপের সহযোগে আগাচ্ছি। কথা বলছি কবিতা নিয়া ফলে এ ছাড়া আর কি করার আছে। যাক কোন হায়ারারকিমূল ব্যাপার হচ্ছে না অন্তত। এটা ভাবতে ভাল লাগছে। আসলে বাইনারী ফর্মে কথা হইলে হায়ারারকি অনেক সময় এড়ানো যায় না। সেই জন্যই বলতেছিলাম আমরা যে ভাষা ব্যবস্থাপনার মধ্যে আছি, যে চিহ্ন-ব্যবস্থার মধ্যে আমরা কারবার করি তার সিলসিরায় কবিতা নিয়া আলাপের ফলে একটা পারভারশন তৈরি হয়। আমরা কেবল কিছু লিনিয়ার ইতিহাসচিন্তা, রুচি, ব্যক্তিপছন্দ, শিল্পদোহাই বা ব্যক্তি-আমি-সমাজ। এইসব গিভেন বা আগে থেকে হাজির অবস্থাকে আমলে নিয়ে কবিতা আলোচনা করতে বসি। বা কবিতা নিয়া কথা বলি। অথচ কবিতা জিনিসটা গিভেন না। এমনকি ভাষালিপি বা চিহ্নশৃঙ্খলারূপে হাজিরের আগেই ‘কবিতা’ একটা নিখিল ভাষা হয়ে হাজির হতে পারে। তার জন্য পূর্বশর্ত বাধ্যতামূলক নয়। এই জন্য দেখবেন সকল ভাষার আদিপ্রকাশরূপ কবিতা হিসেবে আজও বিরাজমান। খোদ গদ্য জিনিসটাই আধুনিকতার একটু আগে আগে হাঁটে। এটা কবিতার কোল থেকেই বের হয়েছে। এখানে এতোটুকু থাক। পরে আবার ফিরি।
সূত্রধর : বিষয়ডা তো ক্লিয়ার হইল না। কবিতা নিয়া তাইলে কি করমু? কথা কি কমু না?
কথক : পানিতে ঝাপ দেন। কইলাম তো আলাপের কি তরিকা হবে সেইটা আমরা খুঁজতে চেষ্টা করব। এইটা আগে থেকে জানলে তো আর আমাদের এতো বকবক করতে হয় না। সংক্ষেপে কইয়া দিতে পারি। এটা ভাইবা-চিন্তা কই। অন্যরাও ভাবুন। আামাদের চেয়ে অনেক জ্ঞানীজনও তো ভাবতে পারেন। ভাবতে ভাবতে আগাই।
সূত্রধর: পুরাই সক্রেটিসিয় পদ্ধতি ধরে আগাচ্ছেন। কথা যখন কইতেছি তখন তারে কোন না কোন পদ্ধতি আকারে সাব্যস্ত তো করেই যাবে। কিন্তু কথাকে কথা দিয়া কাটতে কাটতেও আগানো যায়। বা কথাকে ডিকনস্ট্রাক্টও করা যায়। ফলে আমরা চাইলেও সক্রেটিসিয় থাকতে পারব না। যেমন দেড়িদা যখন প্লেটো পড়েন সেটা একদম অন্য জিনিস হয়। প্লেটোনিক থাকার উপায় থাকে না। আমাদের কথাও পুরানা নানান ভাবনা-চিন্তার চিহ্ন ধরে হবে। বাট জিনিসটা চাইলেও পুরানা রাখা যাবে না।
কথক : বাহ আপনি তো খুব জ্ঞানের কথা কইছেন। হুম। তা পারব না। যাক এখানে এই প্রসঙ্গ বাদ থাক। আমরা অনেক কথা বলতে বলতে আশা করি বুঝতে পারব কবিতা নিয়া কথা বলার তরিকা কোন নির্দিষ্ট প্রকরণ ধরে আগাবে না। আমাদের একটা জায়গায় একটু মনোযোগ দিতে হইব। কথাটা হইল, ‘কবিতার শর্ত একমাত্র কবিতা’। এই সার্বভৌম হুকুমত কবিতা নিজেই নিজের উপর জারি রাখছে। এটাইকেই ট্রুথফুল এসেন্স অব পয়েট্রি বলতে পারেন। এটা সবসময় পয়েসি দিয়ে ঘেরা থাকে। তার পরেও কবিতা কীভাবে ‘কবিতা’ -এটা আমরা জানি না। কারণ আমরা জানি না, আমি কেন ‘আমি’। বিনয় মজুমদার এমন করে ভাবছিলেন। ফলে কবিতা কি ভাবে কবিতা এটা আপনি আগাম জানতে পারবেন না। কিন্তু তারপরেও কবিতা কবিতা হয়। আপনি যেমন ‘আপনি’ হন। ফলে বিষয়টা মাস্টারীর মতো ফর্দমাফিক কাজ না। তবে কবিতা নিয়া যে সব আকথা-কুকথা আছে তার কয়েকটি এখানে সাফ করে বলতে চেষ্টা করতে পারি আমরা। তাইলে শুরুর প্রশ্নের ইশারাটা আমরা দ্রুতই ঠাহর করতে পারব। ফলে জলদি-তালে কিছু কথা আমাদের বলে যেতে হবে এখন।
এক নাম্বার কথা হইলো, স্বকীয়তার ধারণা বলে শিল্প-সাহিত্যের কারবারে যা কিছু আমদানি কর হয়েছে তা অতি পশ্চাৎপদ জিনিস-এই কালে এসে এইসব কথা এখনও কেন বলা হয় বুজতে পারি না। মনোযোগ দিয়ে খেয়াল কইরেন, আমরা যখন কোন স্বকীয়তার কথা ক্লেইম করি বা বলি তখন ধরে নেই যে, একটা সাহিত্যের ‘লিনিয়ার’ একটা ধারাবাহিকতা আছে। একটা সরলরৈখিক ইতিহাস কল্পনা করে নিয়ে তাঁর মধ্যে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠির স্বকীয়তার কথা আমরা তুলে থাকি। এর সমাজতাত্ত্বিক ও মনোগাঠনিক দিক নিয়ে বিশ্রী সব ক্যাদরানি আপনি পাবেন বাজারে। যাহোক, এই ইতিহাসের মধ্যে কিছু ‘নাম’ বা চিহ্নকে কিছু বৈশিষ্ট্য দিয়ে আমরা বুঝতে চেষ্টা করি। যেহেতু কোন কিছুরই একরৈখিক কোন হিস্ট্রি হয় না তাই এই চেষ্টা আমার কাছে সবসময়ই হাস্যকর মনে হয়। আপনি ওয়াল্টার ওরফে ভালটার বেনজামিনের ‘কনসেপ্ট অব হিস্ট্রি’ দেখলে বুঝবেন সেইসব ‘লিনিয়ার’ বুঝের কিছু সমস্যা তিনিও এড্রেস করেছেন। আমি বেনজামিনের লাইনে যাবো না। আমি আরও আগায়া গোড়া থেকে দেখতে চাইতেছি, বেনজামিনদের সমস্যা আরও টিপিক্যাল। মার্কসের অসুখ অনেক সৃষ্টিশীল ভাবে এদের উপর সওয়ার হইছে। যাক সেইটা আজ ইস্যু না। কিন্তু এই সময়ে আইসা আপনি যখন স্বকীয়তার কথা বলবেন তখন তো আপনি সর্বনাশা একটা ঠিকানার হদিস দিয়া দিবেন পুলাপানরে। এখনকার সময়টা হইলো ডেমকেয়ার আত্মরতিমগ্নতার সময়। সবাই ভীষণ ডেমকেয়ার ও আত্মকলহে লিপ্ত। আধুনিকতার মধ্যে যে ‘নফসে নাসিসার্স’ তৈরির প্রতিযোগিতা জারি আছে সে এই ধরণের স্বকীয়তার ধারণার মধ্যে এসে একধরণের আমোদ বোধ করেন। কান্ডজ্ঞানের অভাবে হয়ে উঠতে চায় স্টাইল-ফান্ডামেন্টালিস্ট বা প্রকরণ-মৌলবাদি। যে কোন মূল্যে আলাদা তাঁকে হতেই হবে এমন একটা পোকা তারে তাড়া করে জন্মের সময় থেকেই। এতে স্বাভাবিকতার মহত্ব ও সত্ত্বার আনকভারড বা অনোম্মোচিত যে সম্ভাবনা আছে তা ইনজিনিয়ারিং এর কবলে পড়ে পঙ্গু হয়ে যায়। সত্ত্বাকে তো স্বকীয় করা আমাদের লক্ষ না। আমাদের কাজের বা জীবনের উদ্যেশ্যও না। সত্ত্বাকে ‘এক’ করাই তো সত্যের লড়াই। বা সত্যের জন্য যে আকুতি তা তো আলাদা হবার জন্য না। ফলে আমরা যখন আলাদা বা বিশেষ কিছু হইতে চাইব বা করতে চাইব তখন আমরা নামপদের ভিন্নতায় বা রুপকের ফাঁপরে পড়ব। কবি মানুষটা যদি নিজের আমি কে কালের দোষ থেকে রক্ষা করতে না পারে তা হলে তাঁর আচরনের মধ্যে ব্যক্তিক সার্বিকতা প্রবেশ করবে। নিজের চিন্তা ও কল্পনাকে সেরা ঠাওরে সাহিত্যের নামে অত্যাচার শুরু করে দিবে। এটা তো আমরা চারপাশে দেখতেই পাই। এখন যেমন সাহিত্য কর্মী ও কবি বা লেখক রূপকের আড়াল থেকে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। এটা তো সত্তা¡র নিগুঢ় নিবেদনে ‘এক’। এটা যে ‘এক’ এটা কিন্তু কোন ডিটারমিনেশন না। এটা প্রজ্ঞা বলেন বা ইনটিউশন বলেন এটা জানে। যে কারণে মানুষ মানুষকে টানে। মানুষের কাছে মানুষ আশ্রয় নিতে চায়। তাই কবিতার আলোচনা এভাবে কঠিন হয়ে একটা ফ্যালসির মধ্যে চলে গেছে। কবি নিজেরে এক ব্যক্তি মানুষ ভেবে নিজের সৃষ্টি নিয়ে বিভোর হয়ে থাকছে। এই বিভোরতার মধ্যে ডুবে আবেগের কলকিতে টান দিচ্ছে আর শব্দ দিয়ে নানান ভাষ্য তৈরি করছে। হাস্যকর!
তাই গোড়া থেকে মনোযোগ দিয়ে বুঝতে হবে, আমরা একটা ডেমকেয়ার বা ‘ডেসপারেট’ ভঙ্গি নিয়া হাজির হওয়া আতœরতিমগ্ন সময়ে বাস করছি। এটাকে শুধু সিম্পল আধুনিকতার বিকার বলেই ছেড়ে দিলে হবে না। উত্তরাধুনিক ক্যাচাল দিয়েও এই ফাড়া কাটানো যাবে না। এটা আরও মাইক্রো ও মেসিভ লেভেলে চলে গেছে। আামদের নিজের সাথে নিজের বুঝের জায়গা থেকে শুরু করতে হবে। ফলে স্বকীয়তার নসিহত লেখককে হত্যা করার চেয়ে খারাপ। আমি কি আমার পয়েন্টটা বানাইতে পারছি? এখন নিশ্চিয়ই বোকার মতো বলবেন না তাইলে কন কবির কি কাজ?
“ডেরেক ওয়ালকট যেমন বলেন, ‘কবিতা লিখতে যেয়ে কেউ যদি জেনে যায় সে কি লিখতে যাচ্ছে তবে তা কবিতা হবে না, হবে কবিতার কঙ্কাল’। বা সেই পুরানা প্রশ্ন ‘জানাকে’ কি জানি? স্বত এবং স্ফূর্ততা অন্য ভাবেও দেখা যায়, ‘স্ব’ মানে নিজ এই নিজ মানে ‘আমি’ না। নিজ মানে সেল্ফ মানে সত্তা। এখন এই সত্তা তো কোন ভাবেই পারসোনাল ইনডিভিজুয়াল জিনিস না। এটা আরও গভীর ও সহজ জিনিস। স্বতস্ফূর্ততার নামে আমাদের কবিরা তো দেহি ‘ইনডভিজুয়াল টোটালাইজেশন’ বা ব্যক্তির সার্বিকীকরণ করে। তাকে পেয়ে বসে আমির ইগো। ইগো তাকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। কল্পনার জোরে যা তা এসেনসিয়াল করে তুলে এবং কবি হওযার লড়াইয়ে মাঠে নেমে পড়েন। কবি হওয়ার জন্য কখনও কারো সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয় না। কবিতা একমাত্র জিনিস যা বিনা তর্কেই ‘কবিতা’ হয়ে হাজির হয়।”
সূত্রধর : এই আলাপটা এখন তো বিনোদনেরও অযোগ্য হয়ে গেছে, এমন আলাপ আমি করব না।
কথক : মার্কসিস্টদের মতো বেহুদা গণসাহিত্য কনসেপ্ট নিয়াও উতলা না আমি। এগুলা বাজে তর্ক। ‘এই সময়ে লেখক কেবল তাঁর সত্তার সাথে মোকাবেলা করেই আগাতে পারে; মিলান কুন্দেরার এই মতের সাথে আমিও একমত।। আর সত্ত্বার খবরের জন্য তো সবের মঝে লিপ্ত থাকা লাগে। নাম যেহেতু নিতেই হচ্ছে। নোভালিসের কথাটাও বলে দেই, ‘যুক্তি যাদের আহত করেছে তাদের উপশম করে কবিতা। মার্কসিস্ট কবি হলে মাঝে মাঝে এটা বিরক্তিকর হয়। এই পয়েন্টে পরে আবর একটু বলব।
সবার থেকে নিজেরে আলাদা করার অসুখ একটা সিভিলাইজেশনাল বিকার। সত্তা নিজগুনেই স্বকীয়। যদি সেটা ‘সত্তা’ হয়ে ওঠে। প্রথম অংশ নিয়া এখানে কেবল একটু ইশারা দিলাম। এবার দুই নাম্বার পয়েন্টে আসি, ‘স্বতস্ফূর্ততা’ -বাহ শুনতে কি মধুর লাগে। তাই না?
মার্কসবাদিরা এর উত্তেজক সব ব্যাখ্যা দিবে। মনোবিদরা আপনাকে পাগল কইরা দেওয়ার মতো ব্যাখ্যা দিবে। যাক সেটা না শুনলেও চলবে আপাতত। ‘স্বতস্ফূর্ততা’ কি তা কি আমরা জানি? বিশেষ করে একজন কবি যদি নিজের স্বতস্ফূর্ততাও বুঝে যায়। টের পেয়ে যায় কোনটা তাঁর ‘স্বতস্ফূর্ততা’ -তখন তাঁর তো আসলে কিছু করার থাকে না। করার দরকারই নাই। আমি ম্যাটাফিজিকস বা ম্যাটাল্যাঙ্গুয়েজ যুক্তিবাদি গরিমা দিয়া এড়াইতে চাই না যদিও। তবুও বলব, আমার কথায় কেউ যেন দৈব গন্ধ না খুঁজেন দয়া কইরা। বরং যুক্তি বা ম্যাটারের জগৎ বা তথাকথিত দ্বান্দ্বিক জগৎই ম্যাটাফিজিক্যাল বা অধিবিদ্যাজাত বা অবিদ্যা হয়ে ওঠে। ম্যাটেরিয়াল প্যারাডকস বা ম্যাটেরিয়াল এব্যাসট্রাকশ (মাকর্সবাদি/কবিরা যা করে থাকেন)-ফাঁপর থেকে সতর্ক থেকে চিন্তা করতে পারলে চিন্তা করার প্রকৃত চর্চার দিকে আগাই যাওযা শুরু করব মনে হয়। যাহোক, ‘কবি’ আমার কাছে একটা জেনারেল টার্ম, মানে যেখানে ‘পয়েসি’ আছে তা নিয়ে যে কাজ করে তারে ধরেন কবি কইলাম। মানে প্রশ্ন তুলতে হবে, এই যে নানা রকম কাজ এর মধ্যে আর কি কি আছে? যেমন প্রশ্ন হবে ‘হোয়াট ইজ ফ্রি উ্ইল’? ‘ইজ ইট উইল টু পাওয়ার’?- নিৎসে জানে। আমি এইসব বলব না।
‘স্পিরিট অব ফেনোমেনলজি’ কি আমরা খুঁজে দেখেছি? ‘আনকনডিশনাল উইল টু ট্রুথ’ তো সব কাজেই ডিমান্ড করে। তার পরেও আমরা কি সব আগে থেকে ধারণা করতে পারি ? ডেরেক ওয়ালকট যেমন বলেন, ‘কবিতা লিখতে যেয়ে কেউ যদি জেনে যায় সে কি লিখতে যাচ্ছে তবে তা কবিতা হবে না, হবে কবিতার কঙ্কাল’। বা সেই পুরানা প্রশ্ন ‘জানাকে’ কি জানি? স্বত এবং স্ফূর্ততা অন্য ভাবেও দেখা যায়, ‘স্ব’ মানে নিজ এই নিজ মানে ‘আমি’ না। নিজ মানে সেল্ফ মানে সত্তা। এখন এই সত্তা তো কোন ভাবেই পারসোনাল ইনডিভিজুয়াল জিনিস না। এটা আরও গভীর ও সহজ জিনিস। স্বতস্ফূর্ততার নামে আমাদের কবিরা তো দেহি ‘ইনডভিজুয়াল টোটালাইজেশন’ বা ব্যক্তির সার্বিকীকরণ করে। তাকে পেয়ে বসে আমির ইগো। ইগো তাকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। কল্পনার জোরে যা তা এসেনসিয়াল করে তুলে এবং কবি হওযার লড়াইয়ে মাঠে নেমে পড়েন। কবি হওয়ার জন্য কখনও কারো সাথে প্রতিযোগিতা করতে হয় না। কবিতা একমাত্র জিনিস যা বিনা তর্কেই ‘কবিতা’ হয়ে হাজির হয়। অন্য কোন মাধ্যমে লাগে কিনা জানি না। কবি শুধু নিজে মোকাবেলা করেন। কিন্তু এই নিজ যখন আধুনিক ‘আমি’ হয়ে যায় তখন সৃষ্টিশীলতার নামে পারভারশন তৈরি হয়। এটা অন্য তর্ক। তাইলে এই সেল্ফ কি ? এই সেল্ফকে কি আমি জানি? এই সেল্ফের মধ্যে কি ভাবে চিন্তার ও অভিনিবেষের পয়দা হয় আমি কি জানি? আপনি যদি হাইদেগারের ফ্যাশন আমলে নেন তাইলে বলবেন, ‘উই নেভার কাম টু থট, দে কাম টু আস’।
আমরা চিন্তার কাছে যাই না। চিন্তাই আমাদের কাছে আসে। আমাদের এক মুরুব্বি কইছিল, যার পাক-সাফ হওনের ইচ্ছা আছে সে পুশকুনির কাছে আসে। পুশকনি তার কাছে যায় না। কিন্তু পুশকনি না খুড়েই পানির লাফ-ঝাপ দেখাইলে তো মুশকিল। আর এটা কি ভাবে তৈরি হয়? এর রেডিমেট কোন তরিকা নাই। কি ভাবে আসে? কি তরিকায় আসে? কিসের ডাকে ভাবের উদয়? ‘হোয়াট কল ফর থিংকিং’ খুব সহজ জিনিস নয়। এখানে বিস্তারিত বলতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু এতো অল্প জায়গায় তো হবে না। ইঙ্গিতে কই, আমাদের সবকিছু পশ্চিমা চিন্তার ধারা ধরে বুঝতে হবে এমন কোন কথা নাই। এগুলা প্রতিদিনের জীবনের মধ্যেই আছে। এজন্য তান্ত্রিক বা যৌনসাধনা টাইপের দর্শনও চর্চা করার দরকার নাই। যে কৃষক আকাশের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে কখন বৃষ্টি হবে তারে আপনি কি আমলে নিছেন? তাঁর অন্টলজি কি আপনি বুঝেন? ফলে স্বতস্ফূর্ততার ক্যারিসমা আনপ্রিডিকটেবল একটা অবস্থার মধ্যে জাগরিত হয়। যে এই সেল্ফকে ‘কেয়ার’ করে, এর দিকে ঝুকে থাকে, চিন্তা বা ভাব তাঁর কাছে এমনিতেই আশ্রয় করে। আর এই সবের পুরো প্রক্রিয়াটা সেল্ফের মুহুর্তটা কবিতার সাথে সম্পর্কিত। যদিও কবিতা দর্শন না-এটা আমরা জানি। সব ভাষায় ধরতে হবে এমন কোন কথা নাই। ভিটগেনেস্টাইনের মতো ‘ভাষিক টোটালেটিরিয়ান’ও স্বীকার করেন, ‘ব্যবহারিক দিক থেকে ভাষা সবসময়ই অস্পষ্ট। কারণ আমরা যা নিশ্চিত করে বলি তা কখনও যথার্থ ভাবে বলা হয় না’। অন্য দিকে হৃদয়ে প্রার্থনার কথা যদি বলেন তাইলে রিদয়ের ভাষার তো কোন ফরমেট হয় না। হৃদয়ে কেবল সত্যকে পাওয়ার আকুতি থাকে। ফলে পৃথিবীতে কবিতা ভাষার সীমাবদ্ধতাকে শাসনে রাখে। নইলে আমরা চিৎকার অথবা বোবার দুনিয়ায় থাকতাম।
সূত্রধর : এখন কবিতার বিষয়টা কিছুটা আন্দাজ করতে পারা যাচ্ছে মনে হয়। তবে আরও প্রিসাইজ হইলে ভাল হতো।
কথক : প্রিসাইজ করে বলার কিছু নাই। কথা বা শব্দ আপনার গোলাম না যে আপনি চাইলেই সে আপনার মনমতো অর্থকে ক্যারি করে নিয়ে বেড়াবে চিরদিন। পুরো উল্টে দিতে পারে আপনার অর্থের জগৎ। আর তখন বিষয়টা জীবন ও মৃত্যুর মতো গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। তাই আমাদের অসহায়তাটা আগে বুঝে নিতে পারলে ভাল হয়। ফলে স্বতস্ফূর্ততা নিয়ে আহাম্মক না হলে ডিটারিনেস্টক কথাবার্তা বলবে না কেউ। আমি কম জানি ঠিকাসে। বাট আহাম্মক না।
সিস্টেমেটিক ভাবে ভাবতে গেলে বিষয়টা মুখে বলার মতো সহজ না। চিন্তা-ভাবনার দরকার আছে। অন্যদিকে সব কিছুর বাইরে যার কাছে নানা মুহূর্ত ‘উদ্ভাসিত’ হয়। মোমেন্টাম তার সাথে খেলা করে এবং এই খেলায় ভাষা একটা সেকেন্ডারি মাধ্যম আকারে বেশ বড় ভূমিকা পালন করে এবং আমরা কবিতা বা পয়েসি টাইপের যা কিছু পাই তা কি যুক্তিশাসিত ভাষা-শৃঙ্খলা দিয়া ব্যাখ্যা করা সম্ভব?
সূত্রধর : কবিতার ভাষাকে কাব্যিকতা মুক্ত করার একটা ধারা কিন্তু আছে। আবার কবিতাকে ম্যাটাফিজিক্যাল করে রাখতে অনেকে পছন্দ করেন।
কথক : নাহ আমি এই লাইনে যাব না। জন ককতো বলেন, সত্যিকারের কবি কাব্যিক হওয়াকে পাত্তা দেন না। যা হোক, ম্যাটাফিজিকস নিয়ে চিন্তা তো শুরুই হয় নি। পশ্চিমা ধারা এটাকে দ্রুতই সাইডে সরায়া অন্য দিকে হাঁটা দিছে। বস্তুু প্রেমের জীবনব্যবসা হয়ে গেছে দর্শনের দায়িত্ব। এখানে আমি দর্শনের তরিকা ধরেও কথা বলতে রাজি না। দর্শন এমনিতেই আসবে। যেহেতু কবিতার আলোচনা কবিতা না ফলে সেই আলোচনায় রফা করবে দর্শনই। কিন্তু এর মধ্যে কোন প্রেজুডিসের বা প্রাধান্যমূলক সম্পর্ক নাই। বাট এখন আলাপের মধ্যে ফর্মালি আনার দরকার নাই। কবিতা ভাবালুতা বা বস্তুবাদি অথবা ম্যাটাফিজিক্যাল -এই সব কিছু হওয়ার আগে বা পরে কবিতা আসলে কবিতাই। মানে কবিতার সত্য কবিতাই ধারণ করতে পারে। ফলে অন্য পদ্ধতিতে সেই সত্য খুঁজে হয়রান হতে আমি আপাতত রাজি না। দর্শনের সত্য খোঁজার যে ক্রাইসিস কবিতারটা তেমন না। দর্শনে কবিতার অনেক কিছু করার আছে বাট কবিতার মধ্যে দর্শনের তেমন কিছু করার নাই। কবিতা সত্যে অধিষ্ঠিত হওয়ার পরে বা কবিতা ‘কবিতা’ হওয়ার পরে দর্শন ছাড়া তাকে আবার আপনি ফরমাল জ্ঞানের আলাপ বা বিষয় করে তুলতে পারবেন না। তাই বিষয়টা কিন্তু হায়ারারকিমূলক না। যারা যার এসেন্সই এমনটা করেছে। যেটা বলছিলাম, ভাষার এখন যে কাঠামো আমরা ব্যবহার করি। তা একটা যুক্তিভিত্তিক বা সেকুলার কাঠামো, ভাষা জিনিসটার একটা সেকুলারইজেশন হয়ে গেছে। আশার কথা হইল, ভাষা হলো প্রতি মুহূর্তের নির্মাণ। ফলে রেডিমেট একটা ভাষা দিয়া কবিতার সত্যকে ধরতে পারা যাবে এমনটা কেউ বিশ্বাস করবে না। ফলে আমরা যে জ্ঞানগত অবস্থান থেকে কবিতা নিয়া কথা বলি তা কবিতার অনেক বাইরেই থেকে যায়। ভাষাকে আমাদের এখানে বাহিরের জিনিস বা সামাজিক মনে করা হয়। ভাষাকে আমি ‘সত্তা’র কমিটমেন্টের গুরুত্বপূর্ণ ইশারা আকারে দেখি। এই জন্য কোন অক্ষরের প্রতি, কোন বিশেষ চিহ্নের প্রতি আমার প্রেম নাই। অক্ষর শিখলে জ্ঞান হয় না। তাই কবিতার আলোচনা ক্যামনে সম্ভব এই প্রশ্ন আমাদের তাড়া করবে। এর সাথে ভাষার অনেক প্রসঙ্গও চিন্তা করার সুযোগ তৈরি হবে।
জ্ঞান যখন সচেতন হয়ে ওঠে তখন তারে নিয়া মোকাবেলা করা সহজ। কিন্তু জ্ঞান কি ভাবে ‘জ্ঞান’ বা বিষয় কি ভাবে ‘বিষয়’ হয়ে ওঠে তার প্রক্রিয়াতে ভাষা এখনও প্রবেশ করতে পারে নাই। ফলে কবিতার জন্ম হয়। কবিতা ছাড়া আমরা জন্মের সূত্র ধরতে পারি না। ফলে কবিতাকে ভাবাবেগমূলক বিষয় মনে করবেন না। এর গুরুত্ব আমরা আজও আন্দাজ করতে পারি নাই। মার্কসবাদিদের মতো সব কিছু ম্যাটেরিয়াল প্যারাডকস বা ইউটেলিটারিয়ান অথবা ব্যবহারবাদি জায়গা থেকে দেখলে বিপদ আছে। তাই আমি বিনয়ের সাথে অনুরোধ করব এগুলা নিয়ে ফাও ফাও না গ্যাজাইয়া বা ঢালাও কু-তর্ক না তুলে গভীর অভিনিবেশ সহকারে আমাদের মনোযোগ দেবার জন্য জীবনকে অবসর দেয়া দরকার।
আমি-বাসনা-নন্দন
সূত্রধর : ‘কবিতার প্রসঙ্গ উঠলেই দুটো প্রসঙ্গ চলে আসে ছন্দ এবং দশক বা কাল মহাকাল বিশাল বিরাট কবির স্বপ্নজগৎ রেখে যায়’ এমন একটি বহুশ্রুত কথা ধরেই এখন শুরু হতে পারে।
কথক : দেখেন, যে কোন নন্দনতত্ত্বকে যদি নিরীহ-পবিত্র কোন বিষয় মনে করি তাইলে প্রথমেই বিপদে পরে যেতে হবে। নন্দনতত্ত্বর গভীর রাজনীতি আছে। তার কৌমের ইতিহাস ও শ্রেণী-সংষ্কৃতির নির্মাণের বাইরে নন্দন বলে মহান কিছু নাই। দশক এবং ছন্দ এগুলা কু-চিন্তার বিষয় কেন না এগুলা সবই ফর্মাল জিনিস। এটা নিয়া বলার কিছু নাই। আরও দরকারি আলাপে যাই। অন্যদিকে আরও জঘন্য হইল, এগুলার মধ্যে ঘাপটি মেরে আছে কলোনিয়াল চিন্তা/রুচি বা সাহেবের প্রেজুডিস। কবিতা বা যে কোন লেখা-লেখির জন্য এগুলার দুই পয়সারও দাম নাই। কোন কিছু শিক্ষা দেবার খাসিলত সবচেয়ে অশিক্ষিত স্বভাব থেকে তৈরি হয়। তুমি দশক সম্পর্কে ধারণা রাখো না, ছন্দ জানো না… এইসব কথা শুনলে এখন আমরা হাসা-হাসি করি। বাংলাদেশের কবি-সাহিত্যিকদের একটা বিরাট সাংস্কৃতিক ফাঁড়া কি জানেন, এরা লেখা-লেখি করার মধ্য দিয়া রেডিমেট কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিতে উঠার সামন্তীয় প্রতিযোগিতা করতে করতে জীবন থেকে চূড়ান্ত ভাবে পালাতে বাধ্য হয়। লেখা-লেখি তো এখন অলমোস্ট একটা ইন্ড্রাসট্রিয়াল ব্যাপার হয়ে গেছে। আগেও ছিল। লেখক যদি ছাগলের মতো এই ইন্ড্রাসটির ‘ঘেটুপুত্র’ হইতে কুত্তা দৌঁড় শুরু করে তখন কেমন লাগে বলেন? নিজের স্বাভাবিক আবেগ, সংকল্প সব পুঁজি করে লেখক যখন মেইস্টিম বা মূলধারা হইতে চায় এবং মেইনস্টিম হয়ে যায় তখন তাঁর লেখা-লেখি দৈত্যের ফালাফালির মতো মনে হয়। এটাতো তাঁর হেডেকের বিষয় না। অথচ বাংলাদেশের দেখবেন (বিশেষ করে কবিতা নিয়ে) একটা ইগোর লড়াই জারি আছে। কবিতা লেখা ব্যক্তি-ইগোর পূজা হয়ে উঠেছে এখানে। প্রত্যেক লোক যদি মনে করে তাঁর আবেগ-অনূভূতিই সেরা এবং এটার বাজার জাত করে নিজেকে ঐতিহাসিক করে তুলতে হবে তাইলে বিষয়টা কি হাস্যকর হয় না? কবির তো একটা জীবন ছাড়া আর কোন সম্বল থাকে না। এই জীবনের উপর জুলুমকারী যদি কবি হয় তাইলে দুঃখের আর শেষ আছে…?
সূত্রধর : তারপরেও কিন্তু কিছু বিবেচনা থাকেই। এমনি এমনি তো আর একটা দেশের সাহিত্য শিল্প গড়ে ওঠে না।
কথক : শিল্প-সাহিত্য বলে আপনি-আমি সমাজের সব জিনিস কে তো গ্রহণ করি না। এই যে ভিন্নতা ও সব কিছুর ভিতর থেকে শিল্প ও সাহিত্যমূল্য নির্বাচনের পন্থা এটাকে আপনি নিরীহ ব্যাপার বলতে পারেন না। এখন নিশ্চই কোন কিছু শিল্প বা সাহিত্য বলেই পূজনীয় করে তুমুল রব তুললে ব্যাপারটা শিল্প ধর্মের পূজার মতো হয়ে যাবে। আমি, বাসনা ও নন্দনের সাথে সমাজের একটা সম্পর্ক আছে। নন্দনতত্ত্ব জিনিসটা শিল্পে সামাজিকীকরণের ভূমিকা পালন করে। এবং এখানে বিশ্রীভাবে ক্যাটাগরি করা হয়। লোকসাহিত্য বা গ্রাম্য সাহিত্যের ধারণাকে তো আজও ক্রিটিক করা হয় নাই। মার্কসবাদিরাও এগুলো মানে। অথচ এরা কৃষক শ্রমিকের ক্ষতায়নের কথা বলে। বাট এদের সাহিত্যকে মূল ধারা মনে করে না। মাকর্সের মর্ডানিস্ট প্রবলেম তো আছেই। ফলে শিল্পমূল্যের নামে একটা হায়ারারকি তৈরি করা হয়। আর এতে উচ্চ আসনে থাকার জন্য কবি-মানুষ নিজের ‘আমি’র উপর জবরদস্তি শুরু করে। ‘আমি’র আকাঙ্খার নন্দন বাসনা রূপে হাজির হয়। এর সাথে নন্দনের লিঙ্গনিপিড়ক ভূমিকা ও ভোগবাদি হাজিরারও সম্পর্ক আছে। ফলে কোন কিছুকে শিল্পিত নান্দনিক বলে ভাবার বিষয়টি ক্রিটিক্যালি দেখতে হবে। তা না হলে কবির ‘সহজ’ সুন্দরটা মারা পড়বে।
সূত্রধর : কবিতার আলোচনা কি ভাবে সম্ভব এটা নিয়া কিন্তু আমরা খুব বেশি কথা বলতেছি না। রিপিটেশন হলেও এটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরও নানা ভাবে খতিয়ে দেখতে চাই।
কথক : ঠিক। এটা নিয়া বেশি কথা বলার কিছু নাই। আগে যেটা বলেছি, কবিতা নিয়া কি ভাবে আলাপ সম্ভব তা বলতে শুরু করে যে সব ফাও আলাপ আছে তাও দেখে নেয়া দরকার। পরে কি ভাবে আলাপ সম্ভব তার ইশারাটা ইজি হতে পারে। অন্য দিকে কবিতা জিনিসটা যেহেতু নির্দিষ্ট কিছু না। ফলে নির্দিষ্ট ডিসিপ্লিন সেট করে ক্যামনে বলে দেই কবিতার আলোচনা কেমনে সম্ভব? আমরা ডায়লেকটিক্যাল পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা বুঝি। তাই তো ডায়লগ করতেছি। আচ্ছা যেটা বলছিলাম, এর মধ্যে সব চেয়ে জঘন্য চর্চা হলো ছোট কবি, বড় কবি বা অমুক গুরুত্বপূর্ণ তমুক একটা ছাগল এই টাইপের আলাপ। এর মধ্যে কিছু মাথানষ্ট স্বঘোষিত দার্শনিক আছেন এরা করে কি, শ্রেণীচেতনা ও গণমানুষের দৃষ্টিকোন থেকে কবিতাকে নানাভাবে ডিভিশন করে আলাপ করে। পরে এই ডিভিশনকে পোস্টমর্ডানতত্ত্ব¡ দিয়া জাস্টিফাইও করে। খুলে বলি, একদল অতিবিপ্লবী অশিক্ষিত বুদ্ধিজীবী আছে যারা বলে, ফকির লালন বা জালালউদ্দিন খাঁ হলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কবি! শামসুর রাহমান বা এইটাইপের আধুনিকরা বাজে কবি। এরা আবার কলকাতার কবিদের ব্যাপারে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেন। তাঁদের নন্দননিদর্শনের তারিফ করেন। এটা একটা কালচারাল হীনমন্যতার জায়গা থেকে করেন তাও বুঝবেন এদের লেখা-লেখি খেয়াল করলে। যাহোক, এই ডিভিশনটা একটা মূর্খতা থেকে তৈরি হইছে। এই ডিভিশন করে কিন্তু এরা সেকুলার-ডায়লেকটিক বা বাইনারী ফাঁদেই পরে যায়। কারণ ‘ভাল’ কবি ‘খারাপ’ কবি বলে কোন বিষয় নাই। এভাবে কবিতার আলোচনা হয় না। সমাজ বা শ্রেণী দিয়েও না। কারণ কবির প্রক্রিয়াটা একদম ভিন্ন। হাইদেগার বলতেছে, poets demand of us another kind of thinking –less exact but no less strict.
কবির চিন্তা প্রক্রিয়া দার্শনিকের মতো না। বা বলতে পারেন, ম্যাথডলজিক্যাল না। তাই বলে এটা যা-তা চিন্তা করার স্বাধীনতার মতোও না। সে তার জীবনও এর সাথে সত্তার সম্পর্কের মতো একটা নির্দিষ্ট বা যথাযথ চিন্তাই করেন। মানে স্ট্রেইট বা সোজাসোজি চিন্তাই হাজির হয়। সেটা হয়তো দার্শনিকের মতো পারফেক্ট না। এখন কবির এই প্রক্রিয়াকে আমলে না নিয়ে ফাঁও বিপ্লবীপনা দেখাইয়া বিভাজন করলে তো বিষয়টা হাস্যকর হয়। রাহমান সোজাসোজি যে সত্যের উপাসনা করেন, জালাল বা লালন তা করেন না। দুইজনের এই ভিন্নতার মধ্যে ঝগড়া আবিষ্কার করা অশিক্ষিতদের কাছে বড় প্রতিভার কাজ মনে হতে পারে। কিন্তু কবিতার প্রক্রিয়া যারা জানেন, বুঝেন তাদের কাছে দুই’য়ে কোন ভেদ নাই। দুইজনের সত্য অণে¦ষণের প্যারাডাইম ভিন্ন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, সেকুলারাইজড কালচারাল ইনডাস্ট্রিতে আপনি দ্টুারেই পাবেন। জালাল বা লালন ‘সেকুলার’হয়েই হাজির হচ্ছে। আর রাহমানরা তো সেকুলার হওয়াকেই নিজের জীবনের ‘জেহাদ’ মনে করে নিছেন (সেক্যুলার বললে আর আধুনিক কথাটা আলাদ করে বলতে হয় না)। এবং এর অল্টার, ইগো হিসেবে আল মাহমুদও খ্যাত। জাতীয় আবেগ বা গোষ্ঠিচেতনার নিরিখে কবিদের নিয়ে এক ধরনের ইগোর লড়াই সাহিত্য করিয়েদের মাঝে জারি থাকে। উগ্র আমির বাসনাকে সামাজিক করার লড়াইয়ে কাগজ বা মিডিয়াও ভূমিকা রাখে। এইসবই কবির সহজকে কাবু করে দেয়। তাই তো বলি, আধুনিক কালে কবিতা লেখা ময়দানে যুদ্ধ করার চেয়ে কঠিন।
তাইলে হাইদেগারের কথা মতোন দেখা যাচ্ছে কবির যে ভিতরগত লড়াই তা কিন্তু আপনি বাইরে থেকে প্রভাবিত করতে পারছেন না। আপনি বিকৃত করলেও জালাল জালাল আর রাহমান রাহমান। দেরিদা না বললেও আমি মনে করি কবিতা নিজেই নিজের ডিকনসট্রাক্ট করে। নিজের এসেন্সকে নিজেই ধরে রাখতে জানে। তার পরেও লালনে বা জালালে ‘ইনডেজিনাস’ ক্যাপাসিটি খুঁজে বের করে শ্রেণীচেতনা টাইপের বামপন্থা ফলানোর কাজকে কবিতার জন্য জরুরী মনে করি না। এবং সেই ইনডেজিনাস ডমেস্টিক ডিসকোর্সের কালচারাল ইলিমেন্টকে রাজনীতি জ্ঞান করা ও তাঁর ইউনিভারসাল ন্যারেশন হাজির করা যেমন ‘ভাবান্দোলন’ টাইপের উৎকল্পনায় ভোগা কেবল বুদ্ধিশূণ্য উম্মাদের পক্ষেই সম্বব (এগুলো একধরনের ইডিলজিক্যাল ইমানসিপেশনের বা ভাবাদর্শিক মুক্তির অনূভূতি দেয় যদিও)। আর এই ‘অরগানিক’ খুঁজা-খুঁজির তরিকাটাও পোস্টমর্ডান। তাই এইসব ফাও পন্ডিত থেকে সাবধান থাকা দরকার। এরা আমাদের চিন্তাশীলতার নামে চিন্তাবিনাশী প্রবণতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। শাসকরা যেমন গণতন্ত্রের নামে গণবিনাশী হয়ে থাকেন মাঝে মাঝে। মজার ব্যাপার হলো এরা হাইদেগার বা এইটাইপের চিন্তকদের নামেও এইসব কথা বলেন। নিজের সুবিধা মতো যুক্তি তৈরির জন্য লজিক্যাল মিস্টইন্টারপ্রিটেশন দিয়ে থাকেন। ফলে কবিতার আলোচনা আসলে কোন তরিকায় সম্ভব তা গোড়া থেকে আমারদেরকে চিন্তা করতে হবে।
সূত্রধর : আগে একবার বলছিলেন, কবিতা মাধ্যমে ভাষার তো একটা মুক্তি ঘটে…?
কথক : আমি দেখি আমাদের এখানে লোকে ভাষা আর চিহ্ন, হরফ বা বর্ণমালাকে গুলিয়ে ফেলেন। ভাষা তো কবিতার মধ্যেই আশ্রয় করে। কবিতা তো মূলতঃ মৌখিক শিল্প। পরে না সেটা লিখিত হইতে শুরু করছে। এটা তো সবাই এগ্রি করবেন যে মুখের ভাষার স্থির-নির্দিষ্ট বা কমন কোন স্ট্রাকচার নাই। আমি চমস্কীয় ইউনিভারসাল গ্রামারের লাইনের লোক না। কিন্তু হরফের বা কোন ভাষার চিহ্ন ব্যবস্থার নানান বিধান থাকে। সেটাকে ভাষা-শিক্ষা নাম দিয়ে শিখানো হয়। তো যেই হরফে বা চিহ্নেই আপনি উদ্ভাসিত হোন না কেন ভাষার বিষয়টি তো হরফের মতো স্থির নির্দিষ্ট নিয়ম ধরে ঘটে না। তাইলে আপনার কাঠামোবদ্ধ লিপিব্যবস্থার মধ্যদিয়ে আপনি কবিতা নিয়ে কেমনে কথা বলবেন? কাজেই কবিতার আলোচনার জন্য আমাদের যে যুক্তি নির্ভর ভাষা ব্যবস্থাপনা তার অসাড়তাও তলিয়ে দেখতে হবে।
“যে কোন আগাম প্রকল্পবাদি রিডিং চিন্তাশীলতার দুশমন। কবির মধ্যে যদি ইন্ডিভিজুয়াল টোটালাইজেশনের রোগ ঢুকে যায় তখন সে গুয়ের ফুল নিয়ে কবিতা লিখবে। বলগাহারা আবেগ দিয়ে যা তা এসেনশিয়াল করার চেষ্টা করবে। এইখানে এথিকসের আলোচনা করতে হবে। কল্পনার বা উদ্ভাসনের এথিকস নিয়ে কথা তুলতে হবে। এথিকস কিন্তু ধর্মমূলক ব্যাপার না।”
সূত্রধর : কবিতো ভাষাকে রপ্ত করতে পারেন। নির্দিষ্ট প্রকল্প ধরে চিন্তাও করতে পারেন। তাঁর স্বাধীনতা তো আছে…?
কথক : ভাষাকে রপ্ত করার কিছু নাই। ভাষাতো তাঁর দমের সাথেই আছে। সে কিছু বর্ণমালা ও তার সহযোগে কিছু শব্দ শিখতে পারে। আর কে না জানে শব্দদাস কবিরা প্রায়ই বিরক্তিকর হন। অনেকে কাব্যিক ঢং-এ লেখা-লেখি করেন। অনেক দার্শনিক তো এই ধারার লেখা-লেখির জন্য খ্যাত। সেটা নিয়ে নিশ্চই আমরা এখন কথা বলছি না।
যে কোন আগাম প্রকল্পবাদি রিডিং চিন্তাশীলতার দুশমন। কবির মধ্যে যদি ইন্ডিভিজুয়াল টোটালাইজেশনের রোগ ঢুকে যায় তখন সে গুয়ের ফুল নিয়ে কবিতা লিখবে। বলগাহারা আবেগ দিয়ে যা তা এসেনশিয়াল করার চেষ্টা করবে। এইখানে এথিকসের আলোচনা করতে হবে। কল্পনার বা উদ্ভাসনের এথিকস নিয়ে কথা তুলতে হবে। এথিকস কিন্তু ধর্মমূলক ব্যাপার না। যে কোন জ্ঞান বা বিষয়ের এসেনশিয়াল এজেনসি চিনতে এথিকস আপনাকে হেল্প করবে। ফলে কবিতার এথিকস যে সত্যকে ধরে নির্মিত হয় তাতে এথিকস-এর প্রশ্নটাও থাকবে। নইলে ভার্স হয়ে উঠবে পারভার্সিভ। যেটা আধুনিক কালে প্রবল ভাবে চোখে পরে। এটা নিয়ে ভাল-ভাবে ভাবতে হবে নইলে জগৎ ও এর স্থিতির এথিক্যাল যে হারমনি আছে তাতে একটা উৎপাত তৈরি হবে। আধুনিক কবিদের মধ্যে এই বিকার বেশি দেখবেন। কল্পনা আর আবেগের বেগে পয়েট্রিক্যাল মিসরিপ্রেজেন্ট এদের মধ্যে আছে। সে তাঁর সেল্ফকে বস্তুর বিষয় ও ব্যক্তি আমি নিপীড়ন থেকে রেহাই দিতে না পেরে শব্দ-বমি করতে থাকে। তখন স্বাভাবিক ভাবেই কবিতার এথিকসের মধ্যে প্রভাব পরে। এরা যখন জাতীয় সংস্কৃতির সাহিত্যিক সম্পদে পরিণত হয় তখন এদের আচরণের ফ্যাসিবাদ আপনাকে বাকহারা করে দিতে সক্ষম।
স্বাধীনতার নামে, নিজের ব্যক্তি ‘আমি’র চয়েসকে এসেনশিয়ালইজ করতে গিয়ে শব্দের সুবিধা নিয়ে কোন কিছুকে পলিটিসাইজ করলে বা আদর্শিক করলে তখন সেটা কবিতার আলোচনার কোন কাজে আসে না। খুব উত্তেজনা হয়। এটা একটা বামপন্থি ব্যবহারবাদি অপকৌশল। এর মধ্যে বিন্দুমাত্র চিন্তাশীলতার লক্ষণ নাই। কিন্তু খুব বিপ্লবী ভাবের কারণে পাবলিক তালিও দেয়, বাট এটা আমাদেরকে কবির ‘করণ’ বুঝতে সাহায্য করে না। অন্য দিকে ভাষাকে জিমনেশিয়ামের মতো জোড়জবরদস্তিমূলক ব্যবহার করলে, নিজের ইচ্ছামতো অর্থের ভার দিয়ে ছেড়ে দিলে এক ধরনের পারভারশন তৈরি হয়। এই পারভারসন তৈরিতে বামপস্থার অবদান অনেক। বাংলাদেশের লেখা-লেখি কেন যেন একটা বামপন্থি ব্যাপার হয়ে থেকে গেছে। অদ্ভুত।
সূত্রধর : কি ভাবে? বামপন্থি ব্যাপার মানে কি? এটা অনেক বার বলছেন ইতিমধ্যে…
কথক : মানে হলো লেখা-লেখি বা চিন্তা-ভাবনার জগৎ যারা ডমিনেট করেন তাঁরা মোটামুটি মার্কসবাদি নন্দন বা সাহিত্য দৃষ্টির ভিতর আটকে আছেন। মার্কসের সমস্যা আগে তো কিছু বলেছিই। এই একই বস্তুবাদি-লিনিয়ার ইতিহাস চিন্তা দিয়া সবকিছু বিচার করেন। কোন কিছুকে মহান মনে করার যে তরিকা তাঁরা বাতলে দেন এবং সেটা একটা স্ট্যান্ডার্ড আকারে মান্য করতে প্ররোচিত করেন। এর জন্য মতাদর্শিক যে উৎপীড়ন তৈরি করেন তা একটা বামপন্থি প্রবণতা। বা সামাজিক উপিযোগিতার নিরিখে বিচারের যে মূলধারা প্রবণতা এটাও একটা বামপস্থি প্রবণতা। এর সাথে সেক্যুলার ডমিনেশন ও মর্ডান রাষ্ট্র ও তাঁর সাংস্কৃতিক ইন্ডাস্ট্রির সহযোগে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে যে লেখক মনে করেন সে সমাজের জন্য বিরাট কিছু করছেন। এইসব এটিচুডকে বামপন্থি বলছি। এটার মধ্যে এক ধরনের এলিটিজম আছে।
লেখা-লেখিকে একটা বিশেষ কর্ম এবং কবি-লেখক বলে একটা হায়ারারকি ক্লেম করার যে হীনমন্যতা তা বাংলাদেশে মহামারির আকার ধারণ করেছে। এর সাথে কিছু পত্রিকার বান্ধা লেখক ও শিশু বুদ্ধিজীবী পয়দা করার যে মিডিয়াবাজি জারি আছে তা আমাদের কালচারাল মূর্খতাকে জেনারেশন টু জেনারেশন কনটিনিউ করতেছে। তাই লেখা-লেখি কোন বিশেষ কাজ নয়। এটা কোন ক্ষমতামূলক কাজ বা ‘জাতে’ ওঠার বিষয়ও নয়। এটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রবণতা। এই জাতে উঠার প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে কত্তো পুলাপান পাগল হয়। কতো মেয়ে সম্মানহারা হয় ভাবলেই শিউরে উঠতে হয়। লেখা-লেখির বিষয়টার সাথে যার সম্পর্ক আছে তা হলো খেলা। ভায়াবহ নিরাসক্তির প্রতি গভীর অতিনিবেশের মধ্যে একটা বিউটি আছে। এই বিউটিটা আপনার তাবৎ নন্দন-শাসনকে হজম করে ফেলতে পারে। এটার সাথে যে নিজেকে কোপআপ করাতে পারে, খাপ খাওয়াতে পারে সে লিখবে। না পারলে লেখার দরকার নাই। কিন্তু কবি হবার জন্য লেখক হওয়ার জন্য নানান কূট ক্যাচাল করে, নানান গ্রুপবাজি, দশকগিরি, তত্ত্ববাগিতা করে, খাদেম পুষে, শিষ্য পেলে, অনুষ্ঠান করে, নিজেকে বা নিজেদের মামুদের কবি-লেখক বানাবার পায়তারা উম্মাদের লক্ষণ। লেখা-লেখিকে অরগানিক প্রক্রিয়ার মতো না করতে পারলে এটা একটা মানসিক অসুখে পরিণত হয়। যা তা লিখে যাওযা, নিজেরে ক্লাসিক করার চেষ্টা করা একটা গূঢ় অসুখ। বাংলাদেশের সাংষ্কৃতিক বামপন্থা, রাবীন্দ্রিক-মৌলবাদিতা ও আধুনিকতার মোকাবেলার অক্ষমতা প্রাথমিক সমস্যা। আর এ অসুখগুলাই হলো মূল ধারার ভেলুজ। এটার জন্য কবিরা হাভাইত্তার মতো আচরণ করে। বুঝেন অবস্থা!
সূত্রধর : রাবীন্দ্রিক মৌলবাদিতা বলে কি বুঝাতে চাইতেছেন?
কথক : এটা অতি সহজ। এটা নিয়ে পার্থ চট্রোপাধ্যায় ও দিপেশরা কাজ করছেন। যদিও তাঁদের কাজের ম্যাথডলজি নিয়া আমার আপত্তি আছে। দিপেশ যেভাবে ঠাকুরের কবিতা নিয়া কথা বলেছেন তা গ্রহণযোগ্য হবে না কতিার আলোচনার দিক থেকে (সেটা অবশ্য তিনি করেনও নি)। দীপেশের ভাষা কবিতাকে বুঝবার মতো নয়। তিনি কবিতার সামাজিক বা রাজনৈতিক বা অন্য কোন দিক নিয়ে ন্যারেটিভ আলোচনা করতেই পারেন। করেছেনও। বাট কবিতার আলাপ হবে না। তাইতো আমার কবিতার আলাপ কিভাবে সম্ভব তা নিয়া কথা বলছি। রবীন্দ্রনাথকে একটা ‘সত্য’ -বলে বিশ্বাস করার যে পৌত্তলিকতা। এবং একটা বাংলা লেখা-লেখি বা শিল্প উৎকর্ষের নিদর্শন বলে মান্য করার যে মূলরীতি তৈরি হয়েছে তা রবীন্দ্র মৌলবাদিতা। এর সাথে বিদেশী আধুনিক আর স্বদেশী মিশেলে একটা পোস্ট কলোনিয়াল অবস্থা তৈরি হয়েছে। যে কারণে দেখবেন রবীন্দ্রভক্ত লোকজন মাথায় আজকাল খাটো হয়। দুনিয়ার তর্ক বা প্যারাডাইম যে শিফ্ট করে গেছে এটা ধরতে পারে না বা মানতে পারে না। রবীন্দ্র ধর্মানুভূতি রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ইজ্জতেরও অংশ হয়ে গেছে, এর বিশাল কালচারাল ইন্ডাস্ট্রিও আছে।
সূত্রধর : অন্য প্রসঙ্গে যাই, লেখকরা কি তাইলে একসাথে থাকবে না। কোন সঙ্গ করবে না? কারো সাথে মিলবে না।
কথক: আনন্দের জন্য, আড্ডার জন্য লেখকদের একসাথে থাকার পক্ষে আমি। কিন্তু কোন পিরালী/ঠাকুরগিরি চলবে না। দশক ও ছন্দ বা এই টাইপের পরাধীন পারোকোয়াল নন্দনতত্বের সাইনবোর্ডঅলাদের নিয়ে কৌতুক করতে অনেকেই নিশ্চয়ই মজা পায়। বাংলা-সাহিত্য আজও অদ্ভূতভাবে ডমিনেট করে সংস্কৃত সাহিত্যের নান্দনিক রুচি। আমি মনে করি আমাদের মেইনস্ট্রিম সাহিত্য এখনও আর্য উপনিবেশ থেকে মুক্ত হইতে পারে নাই। এটা সাহিত্য টু সমাজেও আপনি পাবেন। এবং শিক্ষা ব্যবস্থাপনা এই উপনিবেশ প্রক্রিয়াকে জীবনাদর্শ করে তুলতে কাজ করে। কবির জীবনের সবচেয়ে কম গুরুত্ব এখানে। এখানে ডমিনেট করে রুচি, আদর্শ, কৌম চেতনা বা সেকেলে শিল্পাদর্শ, এখন কর্পোরেট ক্যাপিটাল নীতিও চলে আসছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচক হিসেবে।
অশিক্ষা দিয়ে শিক্ষার শুরু:
সূত্রধর: আমরা শেষ করে দেই। অনেক আলাপ হইছে। পড়া-লেখা নিয়া কিছু কন। আপনিওতো অনেকের নাম ঝাড়লেন। পাঠ্যবই পুস্তকের নাম বলতে পারেন।
কথক: এইতো আসল কথা কইছেন। এতো নাম নিবার দরকার নাই। কিন্তু আমাদের শিক্ষা এমন এক অসুখ তৈরি করেছে যে কিছু রেফারেন্স ছাড়া কোন বক্তব্যের অর্থ যেন আজও মালুম করার মতো মনে হয় না। এটা যে সবার ঘটে তা বলছি না। এগুলা গুরুত্বপূর্ণ না। আমাদের আনলার্ন করতে হবে। অশিক্ষা দিয়া জীবন শুরু করতে হবে। কবির সহজ জীবনের মধ্যে যে বিউটি ধরা পড়ে তার কোন তুলনা নাই। এই শিক্ষা জিনিসটাও কবিতার জন্য কাজের না।
পড়া-শোনার মতো বোরিং কাজ পাঠকের উপর চাপানোর কোন মানে হয় না। বই পড়াটা আমার কাছে ‘যন্ত্র’ ব্যবহারের মতো। পড়ে ফেলে দেই। কোন কিছু মুখস্ত থাকে না, করিও না। ৪/৫ বছর ধরে নানা কিছু আনলার্ন করার চেষ্টা করছি। ফলে আমি কোন ভাবেই পড়ার নসিহত দিব না। আনলার্ন করে অতি সহজ লাইনে ফিরে আসার লড়াই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প আমার। অতি নাপতামি করে, ইগোর প্যাঁচে পরে, বাজারের ভেলকিতে পরে, অমুক তত্ত্বগুরুর ফাঁপরে পরে যে সহজ ভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে পারার মতো ইনোসেন্সি হারাইছে তাঁর মতো দুর্ভাগা আর কে আছে। তার জন্য আমাদের শোক করা উচিৎ। এই জন্য কবি হলেন, এলিভেটর অব লাইফ। অতি পণ্ডিতরা বা বাস্তবের চাপে চেপ্টা হয়ে যাওয়া মানুষ কবিতার কাছে প্রশান্তি পায়। কবি যদি ‘ইঞ্জিনিয়ারিং’ করে এই প্রশান্তিকে খুন করে তখন সেই কবির অবস্থা হয় বকধার্মিকের মতো। ওপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট হা হা হা। পাঠক এটা ধরে ফেলতে পারেন। তখন কবিতার বইটা দিয়ে খাটের পায়ার ঠেকনা ঠিক করে নেন।
বইপুস্তক; অনেকে এটা আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন। কিতাবপূজা এক ধরনের পৌত্তলিকতা। মূর্তি পূজার চেয়ে কম সেনসেটিভ না এটা। এটা করলে আপনি ধর্মপূজারী হতে পারেন। পণ্ডিত হতে পারেন কিন্তু নিজেই ধর্ম বা অভিনিবেশের আঁধার হতে পারবেন না, কবিতা হবে না।
পাঠের সময় আসলে ঘটনাটা কি ঘটে তা গুরুত্বপূর্ণ। একটা অদ্ভুত মোমেন্টাম তৈরি হয়। দেরিদা এগুলা আরও ভাল বলেন। যাহোক এই মোমেনটাম তৈরির কোন ব্যাকরণ নাই। একমাত্র ব্যকরণ হলো, আপনি যদি জীবিত হন এবং যদি কানা না হন (এখন মনে হয় অন্ধরাও পড়েন বিকল্প পদ্ধতিতে) তাইলে আপনি পড়তে পারবেন। মৃত মানুষ পড়তে পারে না। তাই ফাইফ হইল বেসিক রিডিং সোর্স। কথাটাকে এবার আপনি যেভাবে ব্যবহার করেন। আর বাংলাদেশে ‘বইপড়া’ তো রীতিমতো আতঙ্কের ব্যাপার। গরিবের পুলা এম এ পাশ করলে যে ‘গরম’ তৈরি হয় চারপাশে তা দেখলে লেখা-পড়া না করার যে সহজ আনন্দ তা রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম করার দরকারের কথা মনে হয় আমার। বই পইড়া আপনি শিক্ষিত হবেন এমন কোন গ্যারান্টি নাই। আপনি মূর্খও হতে পারেন। অক্ষরজ্ঞান ভয়াবহ। চিহ্ন না বুঝে হরফ ধরে যে জ্ঞান দখল করার প্রতিযোগিতার ফলে বৈষম্য তৈরি হয়। এই সব বিষয় মনে রেখে লেখা-পড়ার প্রতি কোন পিরিত নাই। আমি নিজের জন্য ফ্রি স্টাইলে পড়ি। জোকস থেকে শুরু করে রান্নার বই, ক্যালকুলাস থেকে জ্যামিতি, দর্শন নানান বই পড়ি। তবে বই থেকে সাধারণত ডাইরেক্ট কোন শিক্ষা নেই না। আমার শিক্ষার ভীতি আছে। আমার ওস্তাদ নাসিম লস্কর কইছে, ‘শিক্ষা হইল এমন জিনিস যে, প্রক্রিয়ায়, সবগুলা গাঁধা ছেড়ে দিলে একটা ফার্স্ট হয়’। পড়া-শোনার ব্যবস্থাপনাটাই একটা বিকার তৈরি করে। আমি এডুকেশনফোবিক। পাঠককে আমার কিছু বলার নাই। শুধু বলি এতোক্ষণ কষ্ট করে আমাদের বকবক পড়ছেন তাই ক্ষমা চাই। খুশি হবো পড়াটা ভুলে ইশারাটা বুঝে নিয়ে নিজের সাথে নিজের মোকাবেলায় গেলে। এই ‘নিজ’ মানে পরস্পরের মধ্যের কমন ‘আমি’। একটা গাছের পাতাকে পড়তে পারলে জীবন ধন্য হইত। আফসোস।
“কবিতার আলোচনা তখন সম্ভব হবে যখন বর্ণ, অক্ষর চিহ্ন আর ভাষার সীমা বা আড়ালটা আমরা ভেঙ্গে ফেলতে পারব। অর্থের ভারে শব্দকে ধনুকের ফলার মতো ব্যবহার না করে ভাষার স্ফূর্তি কবিতায় যেভাবে উদ্ভাসিত হয় সেইভাবে আমরা যখন কথা কইতে পারব, তখন কবিতা নিয়ে কথা শুরু করা যাবে। কবিতার শর্ততো কবিতাই। ফলে আপনি-আমি নানান আভাসে অভাষ্যকে জোর করে ভাষার দিকে নিবার কে?”
সূত্রধর: তাইলে কবিতার আলোচনা নিয়া আমরা কিছু কি কইলাম?
কথক: এতোক্ষণ আলাপ করে যা যা কইছি তার মধ্যে যা যা কই নাই বা কইতে পারি নাই তার ইশারাও তো আছে। এই ইশারা আমাদের হয়তো কোন ভাবনার দিকে মনোনিবেশ করাবে। জীবনের মতোই কবিতা শেষ পর্যন্ত অজানা এবং জানবার বিষয় হিসেবে থেকে যায়। তবুও জীবনেই কবিতা ‘কবিতা’ হয়ে হাজির হয়। এই যে হাজিরার সত্য তা তো আর আপনি আগাম জানতে পারবেন না। কবিতার আলোচনা তখন সম্ভব হবে যখন বর্ণ, অক্ষর চিহ্ন আর ভাষার সীমা বা আড়ালটা আমরা ভেঙ্গে ফেলতে পারব। অর্থের ভারে শব্দকে ধনুকের ফলার মতো ব্যবহার না করে ভাষার স্ফূর্তি কবিতায় যেভাবে উদ্ভাসিত হয় সেইভাবে আমরা যখন কথা কইতে পারব, তখন কবিতা নিয়ে কথা শুরু করা যাবে। কবিতার শর্ততো কবিতাই। ফলে আপনি-আমি নানান আভাসে অভাষ্যকে জোর করে ভাষার দিকে নিবার কে?
পৃথিবী-জীবন ও আমির হাজিরা ও অবিরাম বিলয়ের মাঝে কবিতা তার সত্য কর্তব্য ভুলে না। ফলে কবিতাকে কবিতা হয়ে হাজির হতে হয়। মানবকে যেমন মানুষ হতে হয়। মানুষ যেমন জানে না, সে কি! আমরাও জানি না কবিতা কি। অচিন জিনিসের হদিস দেয়া চিন ভাষার কি সাধ্য আছে। কিন্তু সুখবর হলো ভাষার সবটা প্রকাশের দিক না। ফলে এককথায় না বলি কবিতার আলোচনা কিভাবে সম্ভব। কি কি ভাবে সম্ভব না তা যদি বুঝে আসে তাইলে বাকি যা থাকে সবই সম্ভাবনার। হয়তো সবটা আজই প্রকাশিত হইতাছে না। এই আরকি।