‘অ্যা ডিফেন্স অফ পোয়েট্রি’-তে যুক্তির সাথে সংবেদনার ফারাক দেখিয়ে মহামতি শেলী দুয়ের অবিচ্ছেদের কথা কবুল করে নেন, যেখানে তিনি যুক্তিকে বলেন জ্ঞাত গুণের খতিয়ান (enumeration of qualities already known)’ এবং সেই সাথে সংবেদনার ব্যাখ্যা করেন ঐসব গুণবত্তার মনোগ্রাহিতারূপে (perception of the value of those qualities, both separately and as a whole)। যুক্তি-সংবেদের তুল্যতা তুলে ধরতে তিনি একথাও বলেন : ‘Reason is to imagination as the instrument to the agent, as the body to the spirit, as the shadow to the substance’। তত্ত্বপাঠের সাথে রেজাউল করিম রনির কবিতারস বা শিল্প-রসায়নের সহজ যোগসূত্র না থাকলে ‘পরভাষা’র দোহাই না পেড়েও পার পাওয়ার ওসিলা খুঁজতাম, কিন্তু রনির কবিতায় দর্শনের দ্রবণ ঘন হয়ে উঠতে দেখে পাশফেরার স্কোপ ন্যায়ত সীমিতই বলা যায়। ‘গোলাপ সন্ত্রাস’ পার হয়ে ‘দাউ দাউ সুখ’ নিয়ে কবিতার ঠোঙা হাতে হাজির হলেন এই তরুণ, যাতে স্বাদের ব্যঞ্জনা ভিন্নতার দাবি রাখে। ‘কবিতা হইলাম আমি আর আমার গদ্য হইলো সমাজ’ কথাটা এসেছে রনির মুখ থেকেই, তার কবিতায় ‘আত্মতা’, ‘সেলফ-এনগ্রোজমেন্ট’ এবং ‘সেলফ-এনগেইজমেন্ট’ বিশেষরকম জায়গা করে নেয়, ‘স্ট্রিম অফ কনসাসনেসের’ তালটা কেটে না গেলে কূটাভাস থেকে তার প্রাণসত্তার সরল আভাসটাই বোঝা সহজ। অনুভব-সংবেদী পরাশক্তির একটা প্রকাশ দেখি তার কবিতায়, যা কূটাভাসপ্রধান এবং আভাসযোগ্য। ‘দ্য প্রোফেট’ বইয়ে কাহলিল জিবরানের বয়ানে ‘বিউটি’ আর ‘ইটার্নিটি’র যুগ্মতা বা ‘গাঁট্টা বাধা’ সম্পর্কে যা শুনি তার অর্থ : ‘বিউটি’ হইলো ইটার্নিটির একটা মেটাফোর (eternity gazing at itself); ইটার্নিটি নিজেই আয়নায় নিজের মুখ খুঁটিয়ে দেখে; মানুষ নিজেই সেই ইটার্নিটি, নিজেই সেই আয়না (You are eternity and you are the mirror)।
[“I saw my Lord with the eye of the heart (kalb).
I asked, ‘Who are You?’
He replied, ‘You’.
Mansur Al-Hallaj]
স্পিনোজার দর্শনভাব আইনস্টাইনে এসে ঠিকরে পড়লে ‘গড’ এবং ‘নেচার’ মিলে (God and Nature are one) ‘একীভূত অখণ্ড’ (unufied whole) যেভাবে গড বা ইটার্নিটির পরাসত্য তুলে ধরে, কতকটা সেভাবেই (Einstein’s cosmic religion) ‘দাউ দাউ সুখ’ গ্রন্থে রেজাউল করিম রনি ‘অনাদির চাতক’ হিশেবে নিজেরে ফলিয়ে তুললেন, অথবা আমরাই তারে সেভাবে পরিচিত করতে পারি: ১. ‘…বৃষ্টির আয়ু না জেনে ভালোবেসে বসে থাকি/—অনাদির চাতক’ ২. ‘আঁধারে ডুবে ছিল অনাদির জংশন/ হঠাৎ হুইসেলে কেঁপে ওঠে অস্থির অহংকার/—কোমল চোখে রাঙা ঝিলিক’ (দ্র. অস্থি+র-বিভক্তি=অস্থি-এর/ অস্থির=রেস্টলেস, বর্তমান ক্ষেত্রে প্রথমটা গ্রাহ্য); ৪. ‘শব্দহীন রিদয়ে ডুবে দ্যাখো আমি-তুমি সব ফাঁকা/ আছে শুধু পরোয়ার প্রেম’। ‘তৃষ্ণা’ কবিতায় অঙ্গ-রতির আসক্তিভাবে বৈরাগ্য দেখাতে যা বলেন, তাতে প্রেমের ওসিলায় প্রচল কামলিপ্সার কটাক্ষ প্রথমত প্রেমাত্মক সম্পর্কের পরিচ্ছন্নতার উপযোগ টেনে আনে; যখন বলেন ‘আমি তো দেহে ধরেছি অমৃত শ্রী-ধারা’ (সংশয়গন্ধ!) তখনও তাতে অঙ্গছাপানো গুরুত্বারোপের গরজ দেখি না, কিন্তু এর পরে ‘অকালে’ শব্দটা চাপিয়ে দিয়ে ইটার্নিটির আভাস স্পষ্ট করে দেন। মূল প্রস্তাবে ‘অনাদির চাতক’ কীসের আশায় পাগলপারা, বোঝার প্রশ্নে আড়াল সরে যায় এবং বেরিয়ে পড়ে তার কথার চালাকি (আর্টিস্ট্রি অর্থে), ‘অনিঃশেষ তৃষ্ণা নিয়া মানুষ কী খুঁজে তাইলে!…কোন অচিন তৃষ্ণা তারে তাড়া করে?’।
শেকড়যাত্রা এবং স্বভাবসঙ্গতি
পাপ যদি গ্রাহ্য হয় ডিভাইন মোরালিটি’র (প্রত্যাদিষ্ট নৈতিকতা) অবিকল্প তুলাদণ্ডে, তাহলে পাপের হুলিয়া থেকে নিস্তারের তরিকা হতে পারে ভগবানকে কতল করা (যদি তা সম্ভব), এবং/ অথবা হলফ করা যে আমি নিজের খেয়ালে অবিদ্যমান হতে পারি; প্রথম ক্রিয়ার সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করতে চাইলে স্বীকার করতে হবে ভগবান/ ঈশ্বর আছেন, না-থাকলে কতল করবো কাকে, আর দ্বিতীয় প্রস্তাবে আমাকে অবশ্যই অবিদ্যমান হতে হবে এইশর্তে যে, কেউ আমারে সেই দশা থেকে ‘হাজিরি’ দশায় ফেরাতে পারে না। অবস্থাচ্যুতি কিংবা পাপদশা থেকে চোখ-ইশারায় রনি যে (আত্ম)রক্ষার কথা বলেন তা কী শাস্ত্রমতের ‘পাপ/ অনুতাপ’ না কী স্বাভাবিকতার ‘সেক্যুলার ডিসপ্লেসমেন্ট’, সেটা অবশ্য বোঝার কায়দা নাই, তার ব্যক্তিপরিচয় আমার অজানা, এক্ষেত্রে সেইটা বুঝি এর আদিকারণের এক কারণ। আস্থা তার এই বাক্যে যে, ‘অস্থির আত্ম-অহংয়ের শিকার শেষে’ ‘আমরা আবার রক্তের আইলে এসেছি ফিরে’, যা থেকে বোঝা যায় তার শুদ্ধিবোধ তথা ইটার্নিটি-চিন্তা প্রকৃতিসূত্র এবং স্বভাবসঙ্গতির সাথে জুড়ে থাকেত চায়।
‘দাউ দাউ সুখ’ কবিতাবইয়ে উপমাপ্রয়োগ সাদামাটা, বিশেষতার আবদার তাতে খাটানো হয় নাই এবং সাদৃশ্য-উপাদান হিসেবে ‘মতো’-র প্রয়োগ সহজাত অভ্যাসে সম্পাদিত মনে হয়
কথাপ্রবাহ ছন্দ বাকস্রোত এবং
রেজাউল করিম রনির কবিতা নিয়ে ছন্দের আলাপ যদি একটু করি, তার কবিতায় মোটা দাগের যে ছন্দরূপ চোখে পড়ে তা অকাট্য শাস্ত্ররীতির অনুকারকমাত্র নয়; বলতে পারি তার ছন্দ ‘স্বভাবছন্দ’ বা ‘রক্তছন্দ’ বা ‘ভাবছন্দ’ বা ‘আন্দাজধর্মী’ ছন্দ (অজ্ঞতাপ্রসূত না)। অবশ্য ছন্দের প্রতিষ্ঠানে (অনন্ত্যমিলসহ) সাধারণ ভক্তিও তার কবিতায় অলক্ষ্য নয়: ‘সপ্রাণ সবুজছায়া হয়ে তোমার কোলে ছড়িয়ে পড়ি… চলতে চলতে তোমার নামেই জীবনের গান ধরি’। প্রচল কায়দার অক্ষরবৃত্তে প্রতিশ্রুতি প্রায় ঠিক রেখে দুই মাত্রার একটা শব্দের মাঝ-বরাবর করাত বসিয়ে দেন : ‘আমি তো ভালোবাসি এই চুম্বক চোখের নজর/ তোমারে অটলে রেখে নিজেকে করেছি পর’, প্রথম পঙক্তিতে ‘এই’-শব্দটাকে তিনি পার্টিশন করেন এভাবে: ‘এ।ই’, ছন্দের আধুনিক কারিকুরি হিসেবে যেটা বেদাত-জাতীয় ব্যাপার নয় একেবারেই। ভাষার গাঁটগাঁথুনি এবং ‘বাকছিনালিপনা’ (লিঙ্গনিরপেক্ষ ব্যঞ্জনায়) ভেতরে গুলিয়ে থাকা ‘গতিধর্ম’-ই যদি গদ্যকবিতার ছন্দরূপের খাসপ্রকরণ হয়ে থাকে, প্রধানত সেই আলের ধার ঘেঁষেই তার চলাচল, কোথাও আবার ল্যাং মেরে ‘চলার গানে’ তাল দেন একটু কেটে (অথবা তাল যায় একটু কেটে), তবে অনেক স্থানে ‘রিদম’ বা কথাযাত্রা হঠাৎ করে থেমে গিয়ে পাঠকের সহজ আরামে ট্রাবল করে বসে, যেমন, ১. ‘জীবন থেকে পালানোর চেষ্টা জারি থাকে মরার আগ পর্যন্ত’ (ধাক্কা) ২. ‘এখন জোছনার ভালোবাসা সাপের ফণা হয়ে ফিরছে আমাদের নগরে’ (হোঁচট); ৩. ‘আজও নদী সকল ঘুমাতে পারে না যৌবনের দহনে’ (গীতলতা বিঘ্নিত); ৪. ভালোবেসে যে দিতে জানে নিজের শূন্যতায় চড়ে উজাড় উড়াল (অতিশব্দ) / এই সংসারে ভালোবেসে হেরেও ভালোবাসা হারায় না যারা/ তেমন প্রেমিকের থাকে চিরকালই ভালোবাসা যাপন’ (গদ্যযান্ত্রিকতা)’; ৫. ‘প্রেমেরে ওঝাই বাঁধে আত্মবাসনার সাপকে’ (বিভক্তিবাহুল্য)।
ভাষা অলঙ্কার সাজগোজ
‘দাউ দাউ সুখ’ কবিতাবইয়ে উপমাপ্রয়োগ সাদামাটা, বিশেষতার আবদার তাতে খাটানো হয় নাই এবং সাদৃশ্য-উপাদান হিসেবে ‘মতো’-র প্রয়োগ সহজাত অভ্যাসে সম্পাদিত মনে হয় : ১. ‘চিবুকে দেখি হঠাৎ কামনার মতো চরের ঝিলিক’; ২. ‘এই জীবন মেঘের ব্যাদনার মতো’; ৩. ‘ব্যাদনার মতো লেগে আছে বৃক্ষের পাতার ধুলা হয়ে’; ৩. ‘রূপসীর বিলাপহীন কান্নার মতো’; ৪. ‘ঘুমের শব্দের মতো মানুষের পথচলা’। রূপকচিন্তায় কিছু ক্ষেত্রে রনির সৃজনবৃত্তির উৎকর্ষ চোখে পড়ে: ‘কুয়াশার সর’, ‘হাসির তর্জমা’, ‘ধুলার বাতাস’, ‘ঘুমের গোমটা’, ‘বোধিগাছ’, ‘আগুনের ঘুম’ ‘সবুজ জাহান’ ‘সাগরের সিনা’ প্রভৃতি রূপক-অলঙ্কার কাব্য-রহস্য সৃষ্টি এবং শিল্পরূপায়নে সহায়ক। পার্সোনিফিকেশন বা ব্যক্তিত্বারোপের দৃষ্টান্তও টানা যায় : ১. ‘এইভাবে প্রেম তবুও আসে বিষণ্ন আগুনের ছুরতে’; ২. ‘স্বপ্ন পাহাড়ে পাহাড়ে উড়ে বেড়ায়’; ৩. ‘স্থির বৃক্ষের করতলে কালের রেখাগুলো দ্রুত ধাবমান’। অসমাপিকা ক্রিয়া হিসেবে ‘হয়ে’ শব্দের ব্যবহার (‘সপ্রাণ সবুজছায়া হয়ে তোমার কোলে ছড়িয়ে পড়ি’) যেমন বোরিং তেম্নি কবিতাসংগঠনকলার বিচারেও ‘অপ্রীতিকর’ এবং বলতে গেলে ‘খারাপ’। ‘ভ্রমণে ভ্রমণে ক্লান্ত হয় পথিক’—এই বাক্যের সাবজেক্ট এবং ‘সাবজেক্টিভ কম্পিলিমেন্টের’ যোজকরূপে ‘হয়’ শব্দের মতো সমধর্মী আরো অনেক ব্যবহার কবিতার অঙ্গশৈথিল্য-ক্রিয়ার (ইমপোটেন্সি) কারণ হিসেবে কাজ করে।
রস টোন মুড
আগাগোড়া পাঠে যেটুকু বুঝলাম, রনির কবিতা নস্টাজিয়ার কাছে অনেকখানি সোপর্দ হতে চায়, শান্ত রসের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের কথাও বলে ফেলে অনেকসময়, তবে তা উচ্চকণ্ঠ কর্কশতাকে কাছে ডাকে না একেবারেই। রোমান্টিক ভাবব্যঞ্জনায় বিষাদ এসে ভর করে, কিন্তু উত্তরিত আশার কার্নিশে তার ‘রিদয়’ যে লটকানো, বুঝতে দীর্ঘনিরীক্ষার দরকার হয় না: ‘অধরা আগুন হয়ে যতই জ্বালাও/ বৃষ্টি নামবেই’। জীবনানন্দীয় মন্থরতার কলস উপুড় হয়ে মাঝেমধ্যে বিষণ্নতা ঢেলে পড়ে, আসে অবসাদ; তাতে পূর্বসূরি প্রভাবের কথা আসতে পারে—না বলা অযৌক্তিক, এমনকিছু দোষের আকর তা নয়, (তবে শর্ত একটা থাকে, জীবনকে ছাপিয়ে যেতে হবে, সেটা হচ্ছে কিনা অন্যেরাই বলুক) জীবন যা করেছেন তাও তার নিরঙ্কুশ ‘বাপের তালুক’ হতেই পারে না, সেটা কবিতার একটা বিশেষতার দিক মাত্র; একটু যদি খতিয়ে দেখি: ১.‘এইসব বাতাস আর উড়াল-জীবন আছে মানুষের/ পাখনার ভারে, ভ্রমণে ভ্রমণে—ক্লান্ত হয় পথিক’ ২. ‘সব ব্যাদনার পর্দা ফেড়ে আজও পৃথিবী দিনের ঘামে বাঁচে/ গনগনে সূর্যকে চায় আঁধার শেষে?/ কে মনে রাখে, ফুল-রক্ত শিশির শীতল ব্যাদনার রাত/ জীবন অথবা অবেচেতন সব—এইসব রিদয় পোড়া উৎসব’।
দূরযাত্রার আভাস
কাঠামোর ফাঁদে কবিতারে মরতে দিতে চান না রনি, ব্লগারসুলভ একটা ক্ষিপ্রতা বা অস্থিরতা বা চমৎকারিতা আছে তার চিন্তায়; সেটা জনপ্রিয়তা এবং জন-অপ্রিয়তার সাথে খানিক ভাব রেখে চলে, অ-ব্লগ যুগে উল্টাক্রমে হুমায়ুন আজাদ মহাশয়ে যার প্রবল মাত্রা আমরা দেখে থাকব। সামাজিকের বদৌলতে গদ্যে তার বিশ্লেষণী ভঙ্গিমা যেমন বোঝা যায়, তেম্নি আনকোরা কথায় একটা ‘চমকবাজি’র চেষ্টাও তার নামে কটাক্ষের সরণি খুলে দেয়। বলি কি, সেটা তার বলের দিক, উনতার দিক নয়; একে নিন্দা ভেবে গাল ভারি না করাই তার জন্যে, এমনকি আমার জন্যেও শ্রেয়। পোস্টে-পুস্তকে কবিতার অঙ্গশীলন তার পক্ষ থেকে যেটুকু দেখি, তার চেয়ে বড় মাত্রায় দেখতে পাই দূরগামী কণ্ঠস্বরের আভাস, যা তার বয়সী (কাব্য-বয়স) অনেক-অনেক পার্শ্বযাত্রীর বেলায় অরণ্যরোদন বৈ নয়। দূরগামিতার খেয়াল থেকে তিনি, মোটামুটি বলা চলে, সরতে চান না, এটা একটা বড় পজেটিভ দিক মনে হয় আমার কাছে, কেননা সামাজিক ‘স্মার্টনেস’ নিয়ে কবিতা এখন নাটকের ভড়ং ধরে হাঁটতে চাইছে, গভীরগামিতার বহু আবদার একেবারে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে। তার ভাষাভঙ্গিতে (হয়তোবা চিন্তায়ও) একটা ‘প্রতিক্রিয়া’র ঢং (যার সাথে চটকদারিতার ঘন যোগ স্বীকারযোগ্য) আছে : ‘নয়া স্বপ্নে সত্য নাই’ [সত্য কেন থাকবে না, এজন্য যে নয়া সত্য মূল সত্যের (পরমের) রিসাইকেল?], যেটা আপ্তবাক্যের আরাম এনে দেবে, একই সঙ্গে জনপ্রিয়তার আবদার পূরণেও ইতিবাচক হতে পারে।
অভিন্ন জালের বিভিন্ন ফাঁশ : নতুন পুরাতন সনাতন চিরন্তন
কালের কবিরা যখন প্রণয়লিপ্সা আর প্রেমস্যাঁতসেঁতে স্পর্শপরতা থেকে ছুটি নিয়ে এক নিষ্ঠুর অপ্রেমের ঘরানায় সেঁধিয়ে আছেন, তখন রনিকে দেখি দিব্যি সেই শুচিবাই থেকে ‘অটোনোমি’ ঘোষণা করতে। নারীপুরুষের হৃদয়সংহতি অর্থে ‘ভালোবাসা’, রক্তমাংসের ঘনিষ্ঠতা অর্থে ‘প্রেম’, আবেগের উৎসারক অর্থে ‘হৃদয়’, নারীনির্দেশক অর্থে ‘তুমি’, অঙ্গঘনিষ্ঠতার উপঢৌকন অর্থে ‘চুমা’ ইত্যাদি শব্দের দেদার হাজিরা ব্যক্তিত্ব ও রুচিরক্ষার গৎ-বাধা টেনশন থেকে রনিকে রেহাই দিচ্ছে। মানবপ্রকৃতির এইসব অমূল্য নিদর্শনগুচ্ছ কার হিম্মতে রহিত হতে চেয়েছিল সে প্রশ্নের প্রহার থেকেই হয়তোবা গুটিকতেক শব্দের প্রচল বানানে চড়াও হয়ে তিনি একটা ভিন্নতা রচনা করতে চেয়েছেন। ‘হৃদয়’ শব্দটার প্রচল বানান স্বেচ্ছাচারে ভেঙে তিনি ‘রিদয়’-রূপে হাজির করেন, একটা বিশেষ ভাষাপরিস্থিতি তাকে যে বাধ্য করেছে তা নয়, আগাগোড়া এই প্রবণতা মেনে চলার কট্টর অ-ব্যতিক্রমে সেই সত্য পরিষ্কার (এক জায়গায় অবশ্য ‘রিদয়’ না লিখে ‘হৃদয়’ এবং অন্য স্থলে ‘চুমা’ না লিখে ‘চুমো’ এবং আরও এক স্থানে ‘গ্যাছে’ না লিখে ‘গেছে’-রূপেই থেকে গেছে, ভুলে কিংবা সচেতনে)। তুমি-আমি-হৃদয়-ভালোবাসা-প্রেম-চুমার অধ্যায়ে রক্তমাংসের অনেক লক্ষণ পার হয়ে কখনো তিনি যে পরমতার ছোঁয়াচ দিয়ে যান তা অবশ্য ‘ছিঁচকাঁদুনে রোমান্টিকতা’র ভার থেকে তাকে মুক্ত করে দেয় : ‘তোমার আমার সব নিঃস্বতার মাঝে গায়েবের শর্তের মতো জারি থাকে ভালোবাসা’—‘গায়েব’ শব্দটা আমার বক্তব্যের পক্ষ টেনে কথা বলবে নিশ্চয়ই। বিকল্প নজিরও সম্ভব : ১. ‘ধ্যানী বোধিগাছ বুঝে গেছে এই উৎসব/ এইসব ভালোবাসাবাসির বেলা সব চতুর খেলা/ —আসলে শেষ সত্যের অবহেলা’; ২. ‘শূন্যতার মহিমা না বুঝে আমরা দেখি বস্তুর সংসার/ তার শান্ত চিবুকে বাস্তবের ঘাম দেখে/ লবণের ভারে ফুলে ওঠে সাগরের সিনা’; ৩. ‘সময়ের গর্ভকুল ভরে আছে গায়েবি বাতাসের বেগে’।
সরলীকরণ : দার্শনিকতার বয়ান
ব্যষ্টিক অভিজ্ঞতায় সার্বিকের সারসত্য প্রকাশে চিরন্তন দার্শনিকতার জ্বরে আক্রান্ত রনির অনেক কবিতাবাক্য, সেসব স্থানে ‘ফিলোসোফাইজিং’ এক শান্তিপূর্ণ অভিজ্ঞতাই বলা যায় : ১. ‘মেটে না তৃষ্ণা তবুও, মানুষের জীবন কেবলই ভ্রমণময়’; ২. ‘…মানুষের জন্ম কেবলই বৃষ্টিময়’। ‘নিজের গভীরতম সত্যে যে আজও সুন্দর হয় নাই,/ তার ভালোবাসায় নোনা সাগরের স্বাদ’—একথা যখন তিনি বলেন, মনে পড়ে চারপাশের সামাজিক চেহারা এবং চেনা-অচেনা অগুনতি মুখের ছবি; রনি তাদের চিনতে পেরেছেন ধরে নেওয়া যায়। আরেকটা উদাহরণ টানা যায় : ‘আমাদের চোখে ডুবে থাকে মুছে যাওয়া ধুলার দিন/ জীবনে মরণ মিশে থাকে, জন্মই শোধে জলের ঋণ’।
কবিতায় চলতি কালের পেইন্টিং আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তিনি কালের সীমা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে চিরায়তের পেইন্টব্রাশ মেরে দেন, এটা তাকে আলাদা গুণে চিনিয়ে দেয়
রাজনৈতিকতা/ কালচেতনা
চলতি পটচিত্র মাথায় রেখে বিষয়টা দেখলে তার প্রতি জুলুম হতে পারে, রাজনীতি অনুষঙ্গে রনি যা বলেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা সময়ের লম্বা উজানপথের নিরিখেই দেখা চাই। ‘অতীত সময়ের মধ্যে সমস্ত নেতারা মরে গেছে’—এই যখন তার বিবেচনা, তার পরেও প্রশ্ন তার ‘একটা চোখও কি আর খোলা নাই স্বপ্ন দেখার?’। এই যে চিত্রখানা, পেছনদশকেও তা সত্য ছিল, আগামদশকেও তার ফারাক দেখব মনে হয় না, বর্তমান বাদই দিলাম। এছাড়া আরো কিছু উদ্ধৃতি দেখালে তার রাজনৈতিক সজাগতার প্রমাণ হতে পারে : ১. ‘শুধু ঘুমকাতুরে হয়ে যায় আমাদের কালের নায়কেরা’; ২. ‘সে মতো আমরা দেখি লোকসভাতে নাচে, কাঁদে, …কিছু কণ্ঠের কল’; ৩. ‘ইতিহাসের ভিতর থেকে জেগে চোখ তুলে তাকাইলে দেখা যায়/ কানা গলির তল থেকে, পথহীন পথ থেকে—/ একটা লাজুক ভোর আসতে আসতেই পথ হয়ে গেল ময়দান,/ আর পদচ্ছাপগুলো ধীর ধীরে মিছিল হয়ে উঠছে’। ‘বারুদ সময়ে’ ‘চুমার স্বাদ’ ভুলে যাওয়ার অনুজ্ঞায় তিনি বলেন : ‘বারুদে ভরে নাও তোমাদের শূন্যগর্ভ বিষাদ’।
কালচেতনা ও ইতিহাস সংবেদ : কালোত্তরের অস্পষ্ট পেইন্টব্রাশ
চিরায়ত ‘মন্থরতা’য় তার ঝোঁক দেখতে পাই, তবে কুয়ায় আটকে পড়ার আগ্রহ তার নাই; কালের খবরেও কান পাতা তার, কবিতায় চলতি কালের পেইন্টিং আঁকতে আঁকতে হঠাৎ তিনি কালের সীমা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে চিরায়তের পেইন্টব্রাশ মেরে দেন, এটা তাকে আলাদা গুণে চিনিয়ে দেয় : ১. ‘কচি গমক্ষেতের আইলে বিহ্বল শালিখ সূরযের আয়ুর কথা ভুলে/ একটি ভোরের জন্মের অপেক্ষায় ঠায় দাঁড়িয়ে’; ২. ‘পাড় ভেঙে যে মাটি মিশে গেছে নদীর রিদয়ে/ ঢেউয়ের ব্যাদনার কথা পাক খেয়ে খেয়ে/ আজও কি টোল তোলে তোমার ভরাট চোয়ালে’; ৩. ‘পুত্র নয়, কন্যা নয়, আমাদের সন্তান যেন বারুদের মতো মোলায়েম হয়/ বারুদ জানে গাছের ছায়ায় ঘুমাতে,/ সময় দখল হলেও বারুদসন্তান বাতাসের ডাকে দেয় সাড়া’ ৩. ‘ইতিহাস রং মাখলে পলির ঘামে বারুদেরও উষ্ণতা বাড়ে।/ বারুদসন্তান অনঙ্গে ধরেন জ্বলে উঠার অনিশেঃষ সৃজনপ্রতিভা/ বারুদ-মৌসুমে জন্ম মানুষ জানে—/ সময়কে কিভাবে জ্বালিয়ে ইতিহাস করে তুলতে হয়’।
টাইম রিফ্লেক্স : অতিক্রান্ত কালের মদিরা
কালের কব্জায় জীবনের অতিক্রম আটকা পড়ে যায়, কেউ তারে ফেরাতে পারে না, এই সত্য তার কবিতায় ধরা পড়ে এভাবে : ‘তোমাদের এত এত পোষা অতীত বলো কোথায় গেল?/ আমারে কেউ এবার গত দিনের হাসি অথবা/ কান্না দেখাও অবিকল!’। মানবিক অনুভূতির আস্তরিত ধূসরতা অতিক্রান্তকালের গহ্বরে অবরুদ্ধ, অথচ তার রিফ্লেক্স স্মৃতি-আয়নায় উঠে আসে, সে কথার ইশারা মেলে রনির কবিতায় : ‘রিদয়ের দেউরিতে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়ে একটি হাসি/ জীবনের সব পার জুড়ে আজ জোছনার বিস্তার/ অধরা হাসি জলের ভ্রু-ভঙ্গির মতো ছড়ায় জীবনে’। অন্যত্র : ‘কোথায় গেছে আমাদের মহান মৃতরা?/ এরা তো কোথাও যায় না।/ চিহ্নহীন ফিরে ফিরে আসে সবুজের অসিয়তে।/ আজ নয়, কাল নয়, অন্য কোনো দিনের হিশাব/ আমি তো ভালোবাসি প্রতিটি নিশ্বাসের সমান বয়সী জীবন নিয়ে/ তোমাদের ধুলাখেলা—অলীক অবহেলা’।
বেদনাবর্তনী : হৃদয়ঘট
রনি ভালোবাসেন ‘অফুরান কান্নার দম নিয়া’ ভালোবাসতে, তার কাছে মনে হয়, ‘এই জীবন মেঘের ব্যাদনার মতো’ এবং তিনি মনে করেন ‘নিজের সাথে বাস্তবের অথবা ছায়ার যুদ্ধ যত/ —সবই’ মানুষকে ‘জলময় করে’—ডাঙায় উঠলেও মানুষের জলনিস্তার ঘটে না, চোখের অকৃত্রিম ধারাজলেই তাকে বেঁচে থাকতে হয়। তার বিশ্বাস : ‘হাওয়ার গতির কাছে সমুদ্রের অনেক-অনেক দিনের কান্নার/ দিনলিপি জমা’ থাকে। বর্তমান তার কাছে জিরানোর অবকাশ মাত্র, যে বোধ তিনি অর্জন করেন সময়ের বাস্তবতা থেকে, চলতি কালের ধূসরতা ও ‘ইনফার্টিলিটি’ থেকে : ‘এই পথচলা, এই জিরানোর জামানায় তবুও ব্যাদনা থেকে যায়/ মুখোমুখি বসে ডাকি রাতের জালালিকে …জীবনে দিনের বয়স বাড়ে সোনালি ঘামের প্রতীক্ষায়’।
মৃত্যুকল্প বনাম নার্সিসিজমের অবলোপ
জীবনের পয়লা ধাপ মৃত্যু, জাতকের প্রথম চিৎকারে মৃত্যুর আজান বেজে ওঠে জগৎ চরাচরে, এই সত্য রূপায়ণে রনির তাগিদ ছলনালুপ্ত মনে হয়। ‘এই পৃথিবীর রূপ-রস আর মানুষের ঠাটের জীবনের ’পরে মৃত্যুর পাহারা সত্য/ তবুও বাস্তবের ভেদ, সংসারের মেদ ও জীবনের মিহি হিশাব যত/ আমারে কাঁদায় থেকে থেকে’। চিরায়ত প্রেমরূপের ধস দেখে রক্তাক্ত কবির মনে আক্ষেপে-অবক্ষেপে ফেঁপে ওঠে, তার কণ্ঠ : ‘যে নদীর জলকে গভীর ভেবে পরিতৃপ্ত ছিলে আত্মপ্রতারণাময় প্রেমে/—তার বুকে আজ জলের হুংকার’।
অপ্টিমিজম ঘাপ্টি মেরে থাকে
‘অধরা আগুন হয়ে যতই’ জ্বালানো হোক তাকে, প্রেমের অশ্রু থেকে যতই ‘জলজ অসুখ’ ছড়াক ‘জনপদে’, রনির বিশ্বাস, ‘পোড়া পলিতে’ বৃষ্টি নামবেই, আগের কথাও স্মরণ করা যায় যেখানে তিনি জীবনকে বৃষ্টিময় বলে বয়ান করেছিলেন। ‘আশারে ছলনে’ ভুলে তিনি প্রাত্যহিক পার্থিবতার দিনলিপি রচনা করেন : ১. ‘ঘামের স্বপ্ন নিয়ে দিন আসে, গোসলের বেলা শেষে—/ আজও পৃথিবীতে আসে তুলতুলা কমলা সকাল’। ২. ‘তবুও আশার অসুখের দোষে মায়েরা হয় বিদ্যুৎ-গর্ভী/ কালে উদর ভরে ওঠে সৈন্যজন্মের ব্যাদনায়’। আশাবাদ তবু হৃদয়ের তলদেশে তলানিতে পরিশিষ্ট থাকে, অনাহূত ধূসরতায় কবিপ্রাণের সম্প্রসার এ-থেকে বোঝা যেতে পারে : ১ ‘পৃথিবীর চেয়ে বিরাট আরও এক জগৎ আছে/ —এই মায়াবী মানুষের সহজ রিদয়ের কাছে’।
বিশ্ববোধি যুদ্ধ শান্তি অস্থিরতা
শান্তির জন্যে যুদ্ধবিশেষ ফলবান হতেই পারে, কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা সাজিয়ে নিয়ে যুদ্ধের পক্ষে কবির সাফাই স্বাভাবিক, মেনে নেওয়া মুশকিল, যখন তৃণমূলের বৃহত্তর মানুষসম্প্রদায় তার পাশ টানতে বলা যায় একদমই নারাজ। সবুরে অতিষ্ঠ হয়ে রনি যে বলেন ‘তবুও তুমি তির ছুড়ছো না!’, তা কেবল বিদ্যমানের বিচ্যুতির নিরিখ ধরে তার বিবমিষাই প্রকাশ করে, কারণ তার বিবেচনা এই : ‘এই শীতল ছায়ার শাসনই দেখতে দেখতে ভালোবাসা হয়ে যাবে একদিন।/ তখনই মানুষের শরীরে জন্ম নেবে অমৃত তৃণ/ মানুষ বুঝে যাবে জলের বোবা তৃষ্ণা/ আমাদের চোখে মিলাবে জন্মলগ্ন সব পথের ঋতু’। ন্যায়যুদ্ধের (!) আসন্নতায় আশাবাদী রনি বলেন : ‘তোমাদের কষ্ট, কান্নাহীন অসময়গুলো/ বারুদখানায় চালান করে দাও’। সমরনীতি প্রশ্নে তার মূল্যচেতনা স্পষ্ট হতে পারে এমন, আরো কিছু কথাসূত্র মেলে ধরা যায় : ১. ‘পৃথিবী চিরকাল অলৌকিক বীরের অপেক্ষায়’; ২. ‘যুদ্ধ মানে আসল লড়াই, শত্রুর বুকে বুলেট নয়/ জীবন বাজি ধরে পৃথিবীর বুকে গেঁথে দেয় কঠিন স্বপ্ন’; ৩. ‘তুমি আলো-অন্ধকারে হাতড়ে কিছই তো পাবে না/ পৃথিবীতে সব ঠিকানা নিহত হয়ে গেছে এটমভোরে’; ৭. ‘ঠিকানাবিহীন এক পাঁঠীর গর্ভফুলে পৃথিবীর বাস/ সেখান থেকে প্রতিদিন পৃথিবী ভূমিষ্ঠ হতে চায়/ আমরা আছি অনন্ত এক জন্মযুদ্ধে’।
‘হরিণের চোখের দিকে চেয়ে’, এই নামের একটা কবিতা পড়ে মুগ্ধতার ঘোরে এক পলকে চেয়ার উল্টে পড়ে যাওয়ার দশা হয়েছিলো প্রায়
রনির চুম্বক : ওয়াইড ট্যাপেস্ট্রি অফ কালারস অ্যান্ড লাইট
পাঠকের মুক্ত বিচারে আস্থা রেখে রেজাউল করিম রনির কবিতার কিছু চুম্বক পূর্বাপর সাজিয়ে দিচ্ছি যাতে আমার ব্যক্তিবিবেচনার বায়াস ও ভুলচুক থেকে (যদি থাকে) তারা বাঁচতে পারে এবং তার প্রতি ক্ষতিপূরণমূলক ইনসাফ করতে পারেন;— ১. ‘নত গ্রীবার ঘাম ঝরার শব্দ পেয়ে আমি এখন আর ঘুমাতে পারি না।/ প্রেমের আগেই চাঁদকে আধারের সরে ঢেকে আমি নৈঃশব্দ্য ধরতে/ সাঁতার কাটছি রাতের অপলক সমুদ্রে/ এখন আমাকে ছুঁলেই লবণের ইতিহাস যাবে জানা’; ২. ‘তোমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের উদরে আছে মৃত নদীর হাহাকার..’; ৩. ‘পায়ের শেষ সীমায় একটা আগুনের ফুল রেখে দিব।/ তখনই মানুষ বুঝবে, নৈঃশব্দ্য-আগুনে কী করে জ্বালাতে হয় একটা জীবন’; ৪. ‘তবুও বেলা শেষে চরের ভেজা বুকে দেখা যায় নীল দাগ/ জলেরও দংশন আছে, শেষ ছোবলের পরে/ নেমে যায় পানি আরও গহিনে জীবনের খুব গভীরে’; ৫. ‘আমি বসে যেতে পারি তোমার গহিন চোখের গেলাফ সরিয়ে/ যেকানে পানির ফোয়ারা বেশ অকৃপণ’; ৬. ‘এই পৃথিবীর সব নীল জমা হবে খায়েশের হিশাবের খাতায়/ …হাসির রেখা ধরে আমি শূ্ন্য হাতে/ ফিরি পাতার সংসারে’; ১০. ‘রিদয়ে গোপন চুমা ঠোঁটে উঠে এসো না/ ধ্যানমগ্ন মধুবৃক্ষ বেড়ে উঠছি, খুন করেছি ভোমরার বাসনা’; ১১. ‘ফ্যাকাশে ধুলার পথে হেঁটে হেঁটে/ ফিরে আসি মরা গাঙের ঘাটে।/পথের ধুলার আস্তরে/ কিছু ক্লান্তি ফেরি করে/ হঠাৎ বসি জিরাবার অবসরে’; ১২. দূর কাশফুলের ঝাড়ে বৃষ্টি অতি নিবিড়/ নদীপারের ঝিরিঝিরি নীড়/ তোমার চোখে গুমোট মেঘের ভিড়’; ১৩. ‘হে মায়াবী জলকন্যা আমারে বৃষ্টির কাছে পৌছাতে তুমি জল হও/ তুমি জল হয়ে নেমে আসলেই জলগুলো সব/ অলৌকিক সুবাসিত ফুল হবে’; ১৪. ‘উন্নয়ন আসছে ভীষণ বেগে, পিঠপেট একাকার/ কিশোরীর তরপেট এবার ভরে উঠবে!’; ১৫. ‘আমি তো তোমার পায়ের নখের উপরে দূর্বার ফুল হয়ে ফুটতে চাই/ তুমি এত ছুটছো… ঘামছো…মাথা থেকে চিবুকে নোনা ঢেউ/ এই লবণ-দৌড়ের সংসারে আজ তুমি ক্লান্ত হয়ে/ একার নিশ্বাসের পাশে ঘাসফুলকি দেখতে পেলে?’; ১৬. ‘কিছু কিছু ফুলও জানে বেয়াড়া পতঙ্গকে বাগে আনতে/ পতঙ্গের অঙ্গলোভ বুঝে সব ফুলে থাকে না সৌরভ’; ১৭. ‘চুপি চুপি দূরে, একটি তারা সব আলো মুছে ফেলে/ তোমার বেণীর মতো শান্ত আঁধারের বাতাসে মিশে যেতে চায়’; ১৮. আমি তো এই চোখের তারায় মজুদ রেখেছি/ বাস্তব বসন্ত-জাহাজ/ তুমি কাঁদালেই ভেসে যাব/ উড়ায়ে দিব তোমার ভেজা ওড়নার পাল’; ১৯. ‘শূন্যতা চেয়েছ বিকাতে শিল্পিত শোভা ধরে/ পাঠিকা নিজেরে ক্লান্ত করে অযথা স্বপ্ন বেচে বেচে’ ২০. ‘…কুকুরপোষা তরণীর গ্রীবার ঘাম/ চেটে খায় বাণিজ্যের ঠোঁট’; ২১. ‘জন্মের আগেই প্রতিটি কুসুম জলজ পাহারায় স্থির/ ঘুমের শব্দের মতো মানুষের পথচলা/ জোছনারাতের খাতাতেই ধরা আছে’।
ব্যক্তিকতা : তাহার জীবনখানি ‘অতি অভিমানী’, ‘নাবালক দুঃখ দিয়ে ঘেরা’
অটোবায়োগ্রাফিক্যাল বাস্তবতায় কবিতায় রনির হৃদয়সংবেদ বোঝা যায়; ‘আমার কান্নার মাঝে ঘুমায়ে আছে/ দাউ দাউ আগুনের ওম’, এ-কথায় পাঠকের সায় আসবে অনায়াসে, কেননা ‘আগুনের ওম’ থেকে চরাচরে কে-ই বা মুক্ত থাকতে পারে! তার নিজের বয়ানে শুনি তার বাণী : ১. ‘তবুও কিভাবে যেন আমার জীবনটা অতি অভিমানী/ নাবালক দুঃখ দিয়ে ঘেরা’; ২. ‘জীবনের স্রোতে কিছু ঢেউয়ের স্মুতি শুধু জমা আছ/ সব অচলতা হৃদয়ে রেখে, দৌড়ের পরে অবশ পা বুকে ধরে/ ফিরি নয়া গাভীর ওলানের মতো স্বাস্থ্যবতী সংসারে’। ব্যক্তিকতার এই তেজস্ক্রিয়া কথকের জীবন ছাপিয়ে অজস্রের জীবনের মধ্যে সত্য হতে পারবে, এমনটা ভাবা যায়।
গুটিয়ে নেওয়ার আগে
ধারালো-ভোঁতা দুই অস্ত্রেই দরকারমতো কবিকে কাটার চেষ্ট করেছি, উপশমের ওষুধও দিয়েছি গুণের কদর করে, তবে সত্য এই: তার কবিতার প্রতি আমার একটা টান আছে, তবে বিরক্তিও কম নাই, গড়ন যথেষ্ট নড়বড়ে, কোথাও কোথাও। তার চারপাশের প্রায় সবার আওয়াজ থেকে তার গলায় একটা আলাদা বিস্তার আছে। ঠিক মনে নাই, সম্ভবত, ‘হরিণের চোখের দিকে চেয়ে’, এই নামের একটা কবিতা পড়ে মুগ্ধতার ঘোরে এক পলকে চেয়ার উল্টে পড়ে যাওয়ার দশা হয়েছিলো প্রায়, যদিও সামগ্রিক অর্থে সেই মুগ্ধতার হুবহু অনুবাদ আমার সাধ্যায়ত নয়। বলা হাস্যকর, তবু বলি, তারো আগে, তার আরেকটা কবিতা পড়ে আমার ওয়ালে শেয়ার করেছিলাম, যখন তারে আমি একদমই চিনতাম না’—এখন যে লিখলাম তার কবিতা নিয়ে, সেটাও তিনি জানেন কিনা আমার সন্দেহ। শেষ কথা এই, তাহারে চিনি না, তাহার কবিতা চিনলাম, কবিতার পথ ধরে।