বাংলাদেশে দেখি সবাই ‘ইভেন্ট’ পূজা করে। যারা এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব পায় নাই কিন্তু পাইতে চায় তারা নিজেরাই ‘ইভেন্ট’ তৈয়ার করে। সবাইরে নিয়ে হল্লা করে। ইভেন্ট এন্ড বিং নামে এলান বাদিউ মজার আলাপ করেছেন। ইভেন্টে থেকে নানান রকম জিনিস জন্ম হতে পারে। সেটা থেকে সহজেই ফ্যাসিবাদেরও জন্ম হতে পারে।
‘ইভেন্ট’ কোন গণতান্ত্রিক ব্যাপার না। ফলে যেইসব পুলাপান সরল মনে গণতান্ত্রিক আচরণ বা সবার ‘সমান মর্যাদাকে’ হৃদয়ে ধরে ‘ইভেন্ট’ আয়োজনে ঝাঁপাইয়া পড়ছে অচিরেই তাদের মোহভঙ্গ ঘটবে। সমাজে পক্ষ আছে, তাই প্রতিপক্ষ খারা হবে এটাই স্বাভাবিক। আবার নিজেদের মতো একটা ‘ইভেন্ট’ করে সবাইরে এক করে রাখবেন এটা হয় না।
বাংলাদেশের লেখকরা মূলত চেতনার অসুখে ভুগেন। আপাত ভাবে যারা বামপন্থি তরিকা-বিরুধী এরাও আচরণে-সাহিত্যে ভীষণ ভাবে মস্কোপন্থি। মস্কাইটরা সবসময় নানা রকম ইভেন্ট করে নিজেদের গুরুত্ব সবার সামনে জানান দিতো। এটা ট্রেডিশনের মতো ছিল। বাংলাদেশেও এই জিনিস আছে। এরা যে মস্কাইট এদের আয়োজনের ধরনে এটা পরিষ্কার। সো এই সব কমজোরি কবি-সাহিত্যিকদের, ইভেন্ট, পলিটিকস আর জ্ঞানতাত্বিক ‘কেলেংকারি’ দেখে বেশ কৌতুক অনুভব করছি। এরা কি পরিমান মূর্খ ভাবলে শিউরে উঠি। এখনও বুঝে না যে বাংলাদেশের ‘প্যারাডাইম’ পাল্টাই গেছে। পুরানা বামাচার বা নয়া ছদ্দ-সেকুলারিটি কে আর্ট-কালচারের নামে পোখক্ত করা যাবে না। বাংলাদেশের পুলাপানের সাহিত্য হবে না। কারণ এরা এখনও কলোনিয়াল নন্দনতত্ব মানে।
লেখকের জীবনটা খুন করে হয়ে ওঠে চেতনার দাশ। গোলামি করতেই এদের আনন্দ। এবং যারা এই নন্দন্দতত্ত্বকে তাত্ত্বিক ভাবে পোক্ত করতে মর্দাঙ্গী ফলায় তাদের ছাতার তলে গিয়া খারায় লেখক হওয়ার খায়েস নিয়া। সেই স্বীকৃতিতে ঢেকুর তুলে নিজেরে মনে করে ঐতিহাসিক ক্যারেক্টার। গরম নাই, শীত নাই চিন্তা এক, তাদের বেশভূষাও এক। ঐ এক থ্রি-কোয়ার্টার পইরা ঘুইরা বেড়ানো। আসলে এরা এক -একটা সঙ, যা ঘরে আয়না না থাকায় নিজেই জানতে পারেনাই, বাইরের মাইনষ্যে জানবে ক্যাবা?
লিটারেচার ও সত্তার রাজনীতি সম্পর্ক না বুঝে এরা যতোই গায়ের জোরে সব মিমাংসা করে ফেলুক না কেন! এরা স্ট্যালিনের চেয়ে বেশি আগাতে পারবে না। আসলে কি এরা ইন্ডিভিজুয়াল টোটালেটিরিয়ান রোগে ভুগতে ভুগত এখন মৃতপ্রায়। এদের প্রবণতাকে আপনি সফিস্ট বালখিল্যতা কিংবা প্রেসবিটারিয়ান ভ্রষ্টাচারের উপমায় ব্যাঙ্গায়িত করলে খুব দোষের হবে না।
যাইহোক, পুলাপানে সাহিত্য রোগ সারাতে হলে থিওরিটিক্যাল ভায়োলেন্স শুরু করতে হবে। সত্তার সাথে বোঝাবুঝি ছাড়া সাহিত্যের আর কোন মানে নাই এখনকার জমানায়।
কিন্তু এরা করে কি? নিজের ব্যক্তিগত সব বিকারকে সত্য ও আদর্শ ধরে সাহিত্য করতে নেমে পড়েন। সত্তা হয়ে যায় অত্যাচারি কর্তা। ব্যস শুরু হইয়া গেলো কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আর কে কারে কই পায়? কোপা শামসু স্টাইলে শুরু লেখক জিবন !!
সো যারা দলে ভিড়ে গিয়ে হল্লা করবে এরা লেখক হিসেবে মূল কাজের মধ্যে নাই -এটা আমরা সহজে বুঝতে পারব। এরা যখন বড় গলায় কথা বলবে তখন এদেরকে নিয়ে আমরা হাসব। এক-একটা ধামড়া শিশু ফালা-ফালি করে কাদাপানি ছিটাতে থাকবে আর আমরাও বলবো বাজাও তালিয়া, টেবিলে সাজও কোপ্তা কালিয়া। এইগুলা ছাড়া সাহিত্য জমে নাকি ?
সো ভায়োলেন্স। থিওরিটিক্যাল ভায়োলেন্স প্রাথমিক কাজ। আমি অতি ইশারায় কথাগুলা কইলাম। এতো অল্প কথায় কোন কিছু পরিষ্কার হয় না। এতে আরও ভুল বুঝার সম্ভাবনা বাড়ে। তাই উদাহরণ দিয়ে আবারও পরিষ্কার করে বলার চেষ্টা করি। একটু খেয়াল করুন, যারা কলকাতা বীরোধী বা পারভারটেড মানবাংলার বিরুদ্ধে একটা নয়া ভাষা জন্ম দিচ্ছেন, ( ভাষা কোন লেখকের জন্ম দিবার বিষয় না যদিও) তারা ‘লিটারেরি ইভেন্ট’ বলে যা ধরে নেয় তা হলো ‘কলকাতা’। এরা কলকাতার বিরুদ্ধে খুব জেহাদি, আওয়ামী কালাচারাল-ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও সোচ্চার। বাট ‘প্যারাডকস/বিভ্রমটা হলো এরা ‘লিটারেরি ইভেন্ট’ বলে যা মানে তা কলকাতাতেই ঘটেছে বলে বিশ্বাস করে। এটা নিয়ে অনেকের সাথে আমার কথা হইছে, তারাও বেশির ভাগই বারবার লিটারেরি ইভেন্টের কথা বলেন এবং সেটা কলকাতা, যদিও লেখায় বলেন মধ্যযুগের কথা চৈতন্য আমলের কথা ( এগুলাইকেই ‘ইভেন্ট’ মনে করেন)। আমি হুমায়ূন নিয়ে কথা বলতে গেলে এরা বারবার ‘লিটারেরি ইভেন্টের’ কথা তুলেন এবং যুক্তি দেখান এটা ঘটেছে কলকাতাতে। ফলে এরা কলকাতা কে মানতে না পেরে বিরোধীতা করছেন একটা রিএকশনারি জায়গা থেকে, এটা পরিষ্কার।
আপনি যখন কলকাতা বা রবীন্দ্র বিরোধীতাকে লেখক-সাহিত্যিক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আপনি ধরে নেন লিটারেরি ‘ইভেন্টা’ ঘটে গেছে কলকাতাতে। ফলে কলকাতার সাথে ফাইট করে আপনার আত্মপরিচয় নির্মমান করতে হয়। এই চিন্তাটা উপরে উপরে বেশ বিপ্লবী, বেশ ভাল। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে এটা চিন্তা হিসেবে খুবই পশ্চৎপদ। কেন? ‘ইভেন্ট’ পূজা বা ‘ইভেন্ট’ -কে ধরে নেয়ার এই ডিটারমিনেশন আপনাকে আরও হীন করে তুলে। আপনি তথন ‘থিউরিটিক্যাল-স্ক্যান্ডাল’ শুরু করে দেন সাহিত্য চর্চার নামে। এই চিন্তার অনুসারিরা যখন দল বেঁধে সাহিত্য করতে নামে তখন সম্মিলিত অশিক্ষার রিহের্সাল আমরা দেখতে থাকি। ‘ইভেন্ট’কে ক্রিটিক করেছেন হেগেল থেকে শুরু হরে হালের জিজেক পর্যন্ত। এটা নিয়ে আমার বেশি কথা বলার দরকার নাই।
এখন এই চিন্তার মধ্যে ‘ইভেন্ট’ ব্যাপারটা কিভাবে ঘাপটি মেরে আছে তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা মজার কাজ হবে। দেখা যাবে এই চিন্তার অনুসারিরা ‘ইতিহাস’ সম্পর্কে খুব লিনিয়ার চিন্তা-ভাবনা করে থাকে। ইতিহাসকে ‘ইভেন্ট’ মনে করেন। এই চিন্তার মধ্যে একটা মেটাফিজিক্যাল বা অবিদ্যার নোশন/আছর আছে। এটা এক ধরনের ‘লোগো-সেন্ট্রেসিজম’ বা পৌত্তলিকতা (–দেরিদা)। ফলে এদের চিন্তার ধরণে আপনি দেখতে পাচ্ছেন একটা ধর্মাচরণ। মুশকিল হলো এরা ভঙ্গিতে লেনিনপন্থি। ফলে এরা হরে দরে যেটা ঘটায় তাকে বলা যায় ‘মেটেরিয়াল-এব্যাসট্রাকশন’ । বা বাস্তবের বিমূর্তায়ন করে একটা বিভ্রম পয়দা করে– এটাকেই বলছি তাত্ত্বিক কেলেঙ্কারি। সংক্ষেপে এদের চিন্তার ব্যাসিক সমস্যাটার ইঙ্গিত দিলাম। এরা দলবেধে সাহিত্য উদ্ধারে নামছে ( দলদারিই এদের শক্তি দেখাবার একমাত্র জায়গা) ফলে আশা করছি ক্রমে ক্রমে এদের সব লক্ষণ স্পষ্ট হবে। আর তাদের লক্ষণ থেকে রোগ শনাক্ত করার আগেই যে সাহিত্যিক মহামারী ছড়াবে তা বাংলাদেশের তরুণ সমাজের সৃষ্টিশীলতা ধ্বংস করে দিতে যথেষ্ট। সো থিওক্রিটিক বা থিওরিটিক্যাল ভায়োলেন্স এর বিকল্প নাই।
”তোমরা যারা ভালবেসে খুন কর,
যারা কাঁদতে কাঁদতে ফুলে ফুলে উপচে দেও লাশের ডালা
জাদুঘরে পাঠিয়ে দাও তোমাদের দরদী রিদয়।
মাতমপ্রিয় আত্মার প্রয়োজন ফুরিয়েছে এতোদিনে।”
–গোলাপ সন্ত্রাস