নিউজিল্যান্ডের মসজিদে হামলার ঘটনায় নানান ব্যাখ্যা ইতমধ্যে বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছে। আমি সামান্য কয়েকটা পয়েণ্ট তুলে ধরছি:
১.
ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম বিদ্বেষ একটি সভ্যতা কেন্দ্রিক ঝগড়া।
‘পশ্চিম’ মনে করে ইসলাম আদর্শগত ও জ্ঞানতাত্বিক ভাবেই
তথাকথিত আধুনিক সভ্যতা নামক পশ্চিমা যে বয়ান তার বিরুধী। ফলে তাদের শত্রুতা প্রকাশ্য। অন্যদিকে ইসলামোফোবিয়া একটি বিলিয়ন ডলার প্রকল্প। বিরাট কর্পরেশন। পশ্চিমে বিশাল বিজনেস এটা। (দেখুন: আলজাজিরা, ইসলামোফোবিয়া করপোরেশন)
ক্রাইস্টচার্চে আজকের হামলায় শ্বেতাঙ্গ খুনিটির ম্যাগজিনে লেখা : acre 1187, এই সালে সালাহউদ্দীন আইয়ুবি (রহঃ) ফিলিস্তিনের শহর আক্রা, তথা জেরুজালেম খ্রিষ্টান ক্রসেডারদের কব্জা থেকে মুক্ত করেন! এর প্রতিশোধ হিসেবে সে এই হত্যা কান্ড চালিয়েছে।
২.
রাজনৈতিক ভাবে সে ট্রাম্পের প্রকল্পের একজন অস্ত্রধারি সমর্থক মাত্র। হামলা বিষয়ে তার যে ৭৪ পাতার বক্তব্য তাতেও ট্রাম্পের কথা উল্লেখ আছে। ফলে এর সাথে সারা দুনিয়ার যে বিশাল ইসলামোফোবিয়া ইন্ডাসট্রি তার সম্পর্ক সরাসরি। অন্যদিকে আষীশ নন্দী দেখিয়েছেন, পৃথিবীর ৭০ ভাগ হত্যার ঘটনা ঘটেছে আধুনিক বিজ্ঞানবাদি প্রকল্পের হেজিমনিক চিন্তার দ্বারা। ধর্মযুদ্ধ বাা ইসলামে বিশ্বাসের কারণে না বরং পৃথিবীতে পশ্চিমারাই বিরাট সব হত্যার জন্য দায়ি। (দেখুন- সাইন্স হেজিমনি-নন্দী)
৩.
এই হামলার ফলে সব চেয়ে বেশি বিপদে পড়েছে ওয়েস্টার্ন জ্ঞানতত্ব। পশ্চিমা উদার নৈতিক দেশ, বিশেষ করে নিউজিল্যান্ডের মতো শান্তির প্রতীক বনে যাওয়া দেশে যখন নামাজরত মুসলিমদের উপর এমন হত্যাকান্ড চলে তখন আধুনিকতাবাদি সভ্যতার সব প্রতিজ্ঞা ও নিজেদের তারা যেই কারণে সারা দুনিয়ার কাছে মডেল বলে দাবি করে সেই প্রকল্প ভেঙে যায়। সব মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় যে তারা ব্যার্থ তা আর প্রমাণ করতে হয় না। অথচ এটাই তাদের ওয়াদা ছিল দুনিয়ার আছে। এবং তারা যে
এইসব বর্বরতার ধারক-বাহক না তা প্রমাণের আর কোন সুযোগ থাকে না।
অন্যদিকে সব মানুষের সমান অধিকার। সব বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা এবং একই সাথে ব্যক্তি স্বাতন্ত্রবাদি ভোগের যে চকটকা দুনিয়ার কল্পনা সে বিস্তার লাভ করাতে চায় তাও মিথ্যা হয়ে যায়। কারণ এই অপরাধ একজন ব্যাক্তি বা মাথানষ্ট কোন একজন বিচ্ছিন্ন ব্যাক্তির ঘটনা না। যদিও মিডিয়া এটাই প্রচার করবে।
এই হত্যাকারি তার কৌমের পক্ষে ঐতিহাসিক বদলা নেয়ার জন্য নিজেকে কুরবানী করে এতোগুলা প্রাণ বিনাশ করার জন্য নেমেছে। তার বক্তব্য এটা স্পষ্ট করেছে। সে কৌমের পক্ষ থেকে এইসব করছে। তাকে ব্যক্তির মানসিক বৈকল্য বলে চালিয়ে দিলে মূল ঘটনার স্রোত আমরা ধরতে পারব না।
৪.
ইডিওলজি ম্যাটার। যে কোন মতাদর্শ ভায়োলেন্ট হয়ে উঠতে পারে -এটা মনে রাখতে হবে। আদর্শগত বিভাজনের দুনিয়ায় নিখিল শান্তির বয়ান একটা কল্পনা মাত্র। ওম শান্তি ওম – খ্যাত ধর্ম, সেই বৌদ্ধবাদের নামে মুসলিম নিধনের কথা সারা দুনিয়া জানে। মতাদর্শ ও মিলিটেন্সি এটা খুব অঙ্গাঅঙ্গি বিষয়। কাজেই একটাকে সন্ত্রাস আর একটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রচার মানে নিরপেক্ষতার নামে একটা সন্ত্রাসের পক্ষেই দাঁড়ানো। যেটা আমাদের দেশের প্রগতীশীলরা করে।
৫.
এখন মুসলিম দুনিয়া ভিকটিম হিসেবে নিজেকে হাজির করবে, নাকি নিহতদের শহীদ হিসেবে হাজির করবে ?
দুটাই থাকবে। মডারেট গ্রুপ দেখাবে সে মুসলিম মাইনরিটি বলে আজ বর্বর হত্যার শিকার তারা। অন্যদিকে ইসলামের মধ্যে শত্রু-মিত্রের পরিস্কার ভেদজ্ঞান টানা আছে -থিওলজির দিক থেকেই । এবং আছে জেহাদের তরিকা। সেই দিক থেকে একদল দেখবে এটাকে জেহাদের দিক থেকে। ইসরামকে যারা রাজনীতি ও জেহাদের বয়ানের বাইরে গান্ধিবাদি তরিকায় পাঠ করে তারা কোন না কোন ভাবে পশ্চিমা সাদা-সন্ত্রাসের বয়ানের ভোক্তা।
এবং স্বাভাবিক ভাবেই মুসিলমরা (রাজনৈতিক সচেতন) যে হামলা হয়েছে এটাকে মানসিক কোন বৈকল্য বা সন্ত্রাসও বলবে না। বলবে, এটা মুসলমান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ইহুদি-খ্রিস্ট ধারার নির্মূলের যে প্রকল্প তারই অংশ। ফলে এর জবাবও হবে মিলিটেন্ট। এভাবেই আমরা আবারও একটি হামলার খবর শুনব।
তখন মুসলিমদের সন্ত্রাসী বল হবে। আর সাদার সন্ত্রাসাকে বলা হবে মানসিক সমস্যা। ব্যক্তির সমস্যা বলে এই ইসলামোফোবিয়ার যে গণহত্যাকারি মিশন তাকে আড়াল করা হবে/হচ্ছে। যা হোক শেষ করি-
এইসব সমস্যার সমাধান কি? রেডিমেট কোন সমাধান নাই। কারণ লিবারাল ব্যক্তি-স্বাতন্ত্রবাদি যে আদর্শ তা কোন ভাবেই লিবারাল না- এটা প্রমাণিত হয়েছে আরও বহু আগেই। তার পরেও পশ্চিমের আলগা মানবতাবাদি ধারার উপর বিশ্বাস রাখার জন্য অনেক উদ্যোগ নেয়া হবে। অনেক আহ্লাদি বয়ান খারা করা হবে। অনেক বানবিক গল্প প্রচার করবে প্রথম আলো টাইপের মিডিয়া।
মুসলমানরা কি ভাবে এইসব সমস্যার সমাধান করবে তার উপরই নির্ভর করছে আগামীর দুনিয়াতে তাদের ভাগ্য কেমন হবে। অবশ্যই ইসলামের ভেতর একটা শক্ত মিলিটেন্ট ধারা আছে। যাকে অবহেলা করার কোন সুযোগ নাই। জঙ্গি জঙ্গি বলে ট্যাগ করারও মানে হয় না। এটাকে এর ম্যাথড ধরেই বুঝতে হবে। যদি আমাদের দেশে এইসব নিয়ে কেউ কথা বলতে সাহসও করে না।
মুলিমদের একটা বড় অংশই এইসব হত্যার ঘটনাকে হঠাৎ ঘটে যাওয়া শোকের বা বিচ্ছিন্ন ব্যাপার হিসেবে দেখে না। চলমান যে ‘ওয়ার অন টেরর’ তার অংশ হিসেবেই দেখে। এবং এই ধরণের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজেদের প্রতিরোধকে তারা জেহাদের ভিত্তিতে জাস্টিফাই করে থাকে। খ্যাতিমান আলেম আনোয়ার আল-আওলাকিকে যখন তাঁর ১০ বছরের শিশু সন্তানসহ ড্রোন হামলা করে হত্যা করা হয় তখন দুনিয়ার বিবেক কোন কথা বলে না। আওলাকি ছোট একটা বই লেখেছেন, ‘ডাস্ট উইল নেভার সেটেল ডাউন’। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। পশ্চিম যে হত্যার মিশন চালু রেখেছে এর চরম মূল্য অবশ্যই দিতে হবে তাকে।
পশ্চিম তার সভ্যতাকে যেমন গ্লোবাল বলে দাবি করে তেমন জেহাদও গত একদশক ধরেই গ্লোবাল একটি ফেনোমেনা।
সারা দুনিয়াতে জেহাদ এবং আধুনিক বিজ্ঞানবাদি ‘সন্ত্রাস’ একটি চলমান প্রকৃয়া। মজার ব্যাপার হল,পশ্চিমারা মুসলিমদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে নিজেরা সন্ত্রাস চালায় সভ্যতার নামে, শান্তির নামে। অন্যদিকে ইসলামে সন্ত্রাসের কোন স্থান নাই। এবং যে ধরণের মিলিটেন্সি দেখা যায় তাকে একটা দল জেহাদের অংশ মনে করে। কাজেই আমাদের বুঝতে হবে কোনটা সন্ত্রাস আর কোনটা জেহাদ। হরে দরে সবকিছুকে ‘সন্ত্রাস’ বলার মানে হয় না।
নিয়ে এখন বেশি বেশি আলাপ দরকার। অবশ্যই এটা নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সবাই তা মনে করে না।
দুনিয়াতে মতাদর্শগত শত্রুতার দিন বিদায় নেয় নাই বরং দিন দিন পোক্ত হচ্ছে।