জ্যাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) প্রায় সবাই জানেন, তিনি একজন দার্শনিক। তার সম্পর্কে বলা হয়, বিশেষজ্ঞের বাইরে খুব কম মানুষই তাকে পড়ে উঠতে পারেন, উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে অনেকেই কাজের ক্ষেত্রে তার নাম করেন কিন্তু খুব অল্পজনই তাকে বুঝেন বা পছন্দ করেন।
দেরিদা সব মিলিয়ে জীবিত থাকতেই ৭০টার মতো বই প্রকাশ করেছেন। আরও ৩০টা বই বের হয়েছে মৃত্যুর পরে। এখনও কিছু কিছু বের হচ্ছে। কারণ তিনি প্রচুর লেকচার দিয়েছেন। যার সবগুলো এখনও ইংরেজিতে পাওয়া যায় না। ২০০৪ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত বিপুল কর্মময় এক জীবন পার করে গেছেন তিনি।
প্রায় সবাই একটা প্রশ্ন করে থাকেন, কেন দেরিদা এত কঠিন? এই প্রশ্নে উত্তর খুঁজতে যাওয়াও একটা জ্ঞানগত ভ্রমণের শামিল। দেখা যাবে, এর মূলে হলো, দেরিদার কনসেপ্ট বা ধারণাসমূহের সঙ্গে আমাদের পরিচয় না থাকাতে তাকে খুব কঠিন লাগে। আমার আরও একটি বিষয় মনে হয়েছে, তা হলো, ভাষাতে সাধারণত যা করা হয়, কোন কিছু সরল রৈখিক বা ব্যাকরণগতভাবে শৃঙ্খলা মেনে প্রকাশ করা হয়। এই যে ভাষার একরৈখিক প্রকাশের ধরন দেরিদা কিন্তু এভাবে প্রকাশ করেন না। বরং ভাষার এই একমুখিতা বা লেখার এই সমস্যাকে লেখার মাধ্যমেই কাটিয়ে উঠেন তিনি। মানে লিখতে লিখতেই লেখাকে ভাঙতে থাকেন, পুনঃনির্মাণ করতে থাকেন।
অর্থাৎ দেরিদার লেখাও পড়তে হবে দেরিদীয় পদ্ধতি অনুযায়ী। যেটাকে সহজে ‘ডিকন্সট্রাক্ট’ পদ্ধতি বলা হয়। এর মাধ্যমে একটি রচনার অসংখ্য ব্যাখ্যা ও অর্থ তৈরি করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে খোদ লিখন প্রক্রিয়াকেই মানে লেখালেখিকেই একটা প্লে-ফুল ব্যাপার করে তুলেন দেরিদা। ফলে আমরা যারা ভাষার মাধ্যমে এক কেন্দ্রিক-সরলভাবে সব বুঝবার চেষ্টা করি তারা দেরিদা পড়তে গেলে হোঁচট খাই, এমনটাই স্বাভাবিক। দেরিদার কাজের বিপুল পরিধি ধরে লিখতে শুরু করলে বিশাল লিখা লিখতে হবে। আমরা এখানে শুধু একটা পয়েন্ট ধরে যতটা সম্ভব সহজ করে আলোচনা করবো।
আগেই বলেছি, দেরিদাকে পড়ে উপলব্ধি করে ওঠা বেশ কষ্টসাধ্য! তাই আমি যতটা বুঝি তা যতটা সম্ভব সহজে উপস্থাপনের জন্য মিলান কুন্দেরার উপন্যাস থেকে একটা উদ্ধৃতি দিয়ে বরং লেখাটা শুরু করি,
“নির্জনতা মানে তা দৃষ্টিগোচর হওয়ার থেকে পরিত্রাণ। দৃষ্টি হলো এমন এক ভার যা তাকে (মানুষকে) মাটিতে পেড়ে ফেলে; অথবা এমন চুম্বন যা তার সব উদ্যম শুষে নেয়।”
অথচ আমরা সবাই দৃষ্টিগোচর হতে চাই। অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য উম্মাদের মতো আচরণ করতে থাকি। ফেসবুক বা যে কোন মিডিয়াকে বেছে নেই নিজের বিকার প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে। আমরা আসলে কেউ নির্জনতার গুরুত্ব বুঝি নাই। ফলে ‘জীবন’ আমাদের কাছে এক নিরন্তর ক্লান্তি উৎপাদনের কারখানা বৈ আর কিছু নয়! জ্যাক দেরিদাকে পড়তে গিয়ে মিলান্দ কুন্দেরার উপন্যাসের এই লাইনগুলোর ভাবনার একটা মিল পাচ্ছিলাম। তাই এই উদ্ধৃতিটা টেনে আনা। কুন্দেরার ‘দৃষ্টিগোচর হওয়া’ বা দেরিদার ‘এপিয়ারেন্স’কে আমি বাংলা করছি ‘হাজির হওয়া’। একে দুটো অর্থে ধরে নিয়ে পড়তে হবে। একটা হলো, চলতি ঘটনা বা ফেনোমেনার আলোকে হাজির হওয়া বা থাকা; অন্যদিকে নিজের (‘বিইং’ বা হাইডেগার যেটাকে ‘দাজাইন’ বলেন) সত্তার হাজির হওয়া বা থাকা।
এবার দেরিদার চিন্তাটা বুঝতে চেষ্টা করা যাক। ২০ শতকের শেষের দিকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তকদের একজন জ্যাক দেরিদা। ফরাসি এই দার্শনিককে ১৯৯২ সালে কেমব্রিজ সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলে অ্যাংলো-আমেরিকান ১৮জন দার্শনিক টাইমস পত্রিকায় এক যৌথ চিঠি লিখে ঐ সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৩০ সালে আলজেরিয়াতে জন্ম নেয়া এই দার্শনিক পশ্চিমা দর্শনের ভিত্তিমূল ধরে টান দিয়েছেন। যুক্তির উপযোগিতা, সত্য ও পশ্চিমের এতদিনের দাবি করা পাণ্ডিত্যকে তিনি পদ্ধতিগতভাবে আক্রমণ করেছেন। ফলে নয়টি দেশের সেই ১৮জন দার্শনিকের ক্ষ্যাপার কারণ বুঝতে পারা কঠিন কিছু না। এখন যখন আবার এই গোটা সভ্যতাই হুমকির মুখে তখন দেরিদা পাঠের সুবিধা হলো, যা এতদিন বুঝতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তা সহজেই বোধগম্য হতে শুরু করেছে। আমি বিস্তারিত আলাপ না করে শুধু এই ‘হাজির’ হওয়া, ইংরেজিতে যেটাকে ‘এপিয়ারেন্স’ বলে এটাই বলে লেখায় ইতি টানব।
‘অব গ্রামাটোলজি’তে আমরা এই ধারণাটা দেখি, ‘the metaphysics of presence’ নামে। এখানে বলে রাখা ভালো এই বইটার প্রথম যে অনুবাদ গায়ত্রী স্পিভাক করেছেন তাতে যথেষ্ট ত্রুটি ছিল। দেরিদার চিন্তাকে তিনিও তখন পর্যন্ত পুরোপুরি আয়াত্ত করতে পারেননি। আমার সঙ্গে এক আলাপে সেই কথা তাকে বলায় বলেছিলেন, ‘তখন বয়স কম ছিল। নতুন চিন্তার প্রতি আকর্ষণের উত্তেজনায় কাজটা করে ফেলেছি। আবার নতুন করে এটা করবো।’ পরে ২০১৭ সালে জুডিথ বাটলারের ভূমিকাসহ এটা নতুন করে মানে, রিট্রান্সলেশন বাজারে এসেছে। আগ্রহীরা যাতে পুরোন বইটা আর না পড়েন তাই এই বাড়তি কথাটা বলে রাখলাম।
আগেই বলেছি, দেরিদার কাজের এরিয়া বিস্ময়কর! প্লেটো থেকে শুরু করে সাহিত্য, কবিতা, আইন সব জায়গায় তিনি কাজ করেছেন। আর সাহিত্য তো বলতে গেলে দেরিদার পরে নতুন এক যুগে প্রবেশ করেছে। সাহিত্যকে এখন প্রি-দেরিদা ও পোস্ট-দেরিদা আমল হিসেবে ভাগ করে পড়া হয়। মানে, দেরিদার ‘ইন্টারভেনশন’ সাহিত্যকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, আপনি এটাকে ওভারকাম করতে পারবেন না, ফেইস করতে হবে। চেতনা দিয়ে পার পাবেন না। যাই হোক যেটা বলছিলাম – এই প্রেজেন্স বা হাজির বিষয়টা আমরা কীভাবে বুঝবো? এই জগৎ ও আমার উপস্থিতির মধ্যে কোন মধ্যস্থতাকারী ছাড়া কীভাবে সম্পর্ক সম্ভব? এটা না হলে হাজির বিষয়টা বুঝে ওঠা যাবে না। তখন যেটা হয় তা হলো, ‘the metaphysics of presence’ মানে আমাদের হাজির/উপস্থিত থাকটাই একটা বিভ্রম আকারে ঘুরপাক খেতে থাকে। আমরা আমাদের হাজির থাকার অর্থ ও তাৎপর্য বুঝতে পারি না।
এখানেই দেরিদা পশ্চিমা দর্শনের ক্রিটিকটা করেন। পশ্চিমা দর্শনে এই হাজির বিষয়টা তৃতীয় কোন মাধ্যম ছাড়া বুঝবার কোন তরিকা নাই। পশ্চিম যুক্তির আশ্রয়ে যেভাবে ‘হাজির’বিষয়কে বুঝতে চেষ্টা করে তাতে একটা ঘাটতি থেকেই যায়। এই যে সময় বিভাজন করে, এই যে লজিক দিয়ে, ইতিহাস চিন্তা করে ‘হাজির’ বিষয়টা বুঝতে হয়, দেরিদা এটাকে ‘লগোসেন্ট্রিসিজম’ বলছেন; আমি যেটাকে ‘পৌত্তলিকতা’ বলে অনুবাদ করি। এই হাজির হওয়ার বিষয়টি আমরা যতটা সহজ ভাবি ততটা সহজ নয়। এটাকে আমরা যে রকম দায়সারা ভাবে এতদিন বুঝে এসেছি তাতে বিরাট গলদ থেকে গেছে। আচ্ছা প্রেজেন্স বা এপিয়ারেন্স ( এই ধারণার আলাপে দুইটা শব্দই ইংরেজিতে পাওয়া যায়)-এর বাংলা যে ‘হাজির হওয়া’ করেছি তাতেও কিন্তু ঠিকঠিক অর্থ বহন করতে পারছে না। ‘উদ্ভাস’ কিংবা ‘জাহির’ করা যেত; কিন্তু সব হাজির-ই তো আর উদ্ভাসিত হয় না। ফলে একে ‘হাজির’ নামেই ডাকা ভাল।
পুরো দেরিদা নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ এখানে নাই। আমরা শুধু এই হাজির হওয়া বা এপিয়ারেন্স এর সমস্যাটা নিয়ে কথা বলব এবং তার সূত্র ধরে ইসলামের সাথে দেরিদার চিন্তার মিলটা অল্প করে উল্লেখ করেই শেষ করবো আজকের মতো। এই হাজির হওয়ার ধারণাটা পশ্চিমা দর্শনে কান্টের হাতে এসে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেছে; কিন্তু এই ভিত্তির মূলে যে বাইনারি বা একের বিপরীতে অন্যকে বুঝবার গলদ তা থেকেই গিয়েছে। সহজ করে বললে, এই এপিয়ারেন্স বিষয়টা রিজন বা কারণের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে।
মোটা দাগে পশ্চিমা দর্শন দেখে থাকে, কি আছে আর কি নাই। দৃশ্যমান যা আছে তাকে হাজির ধরে নিয়েছে, অথচ যা দৃশ্যমান নাই তাকে এপিয়ারেন্স আকারে ধরা হয় নাই। খুব সহজভাবে এই হাজির হওয়ার বিষয়টি দেখা হয়ে আসছিল। এর বাইরে সত্যিকারের জ্ঞানকে খুঁজতে গিয়ে গ্রিক শব্দ ‘লগোস’ ধরে আগায়। যেখান থেকে পরে ‘লজিক’ বিস্তার লাভ করেছে; কিন্তু এই লগোসের গোড়ার ইতিহাসটা দেখলে দেখা যাবে এটা সত্যিকারের জ্ঞানে পৌঁছার দাবি করলেও আসলে যেখানে গিয়ে পৌছায় তাকে দেরিদার ভাষায় লসোসেন্ট্রিসিজম বলা যায়। এর ক্রিটিক অনেক হয়েছে; কিন্তু দেরিদা দেখাচ্ছেন ‘মেটাফিজিক্স অব এপিয়ারেন্স’ বা হাজির হওয়া বিষয়ক ধোঁয়াশাচ্ছন্নতাকে আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারি নাই। আলোচনার জটিলতা এড়াতে সরাসরি দেরিদার রচনায় ফিরে যাওয়াই ভাল।
এই হাজির হওয়ার একটা বড় অংশে আছে আমাদের উৎকল্পনা বা ফ্যান্টাসি। আমরা ‘প্রকৃত যা’ এবং আমাদের ‘হাজির হওয়া’র মধ্যে যে পার্থক্য তা আমরা বুঝতে পারি না। এটার মাঝখানে ‘আকাঙ্ক্ষা’ এমনভাবে আমাদের হাজির হওয়ার বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ‘প্রকৃত আমি’ বনাম ‘হাজির হওয়া আমি’র মধ্যে বিপুল পার্থক্য নিয়েই আমরা জীবন পার করে যাচ্ছি। আবার এই রূপ ধরে বাস করেই আমরা ‘সত্যকে খুঁজে’ চলি। অবশ্যই সেই তালাশ অর্থহীন হতে বাধ্য। দেরিদা ভাষা, লেখা, আত্মজীবনীমূলক বই থেকে শুরু করে এনথ্রোপলজিক্যাল রচনা ঘেটে বিভিন্ন মাধ্যমের দ্বারা ‘হাজির হওয়া’র এই সমস্যাটি বিচার করতে চেষ্টা করেছেন। এই বিচার করতে গিয়েই তিনি যে টার্ম ব্যবহার করলেন তা হলো, ‘différance’. এই ডিফারেন্স বিষয়টা কিন্তু এখানে একটা শব্দ মাত্র না। একটা ধারণা আকারে পাঠ করতে হবে। এই পার্থক্য শুধু ভাষা ও অর্থগত দিক থেকে বিচার করলে হবে না। এটা এই এপিয়ারেন্সের বিচারেও কাজে লাগবে। আমাদের ‘প্রকৃত সত্তা’ আর ‘তার হাজির’এর মধ্যে যে পার্থক্য তাকেও বুঝতে পারা যাবে। দেরিদা পাঠের জটিলতাটাই এই জায়গায়। খুব সজাগ না থাকলে ধারণা ও ভাষ্যের বা রচনার মধ্যে গোল লেগে যায়। ফলে দেরিদাকে বুঝতে গিয়ে উল্টা বুঝ তৈরি হয়।
মোটা দাগে পশ্চিমা দর্শন দেখে থাকে, কি আছে আর কি নাই। দৃশ্যমান যা আছে তাকে হাজির ধরে নিয়েছে, অথচ যা দৃশ্যমান নাই তাকে এপিয়ারেন্স আকারে ধরা হয় নাই। খুব সহজভাবে এই হাজির হওয়ার বিষয়টি দেখা হয়ে আসছিল। এর বাইরে সত্যিকারের জ্ঞানকে খুঁজতে গিয়ে গ্রিক শব্দ ‘লগোস’ ধরে আগায়। যেখান থেকে পরে ‘লজিক’ বিস্তার লাভ করেছে; কিন্তু এই লগোসের গোড়ার ইতিহাসটা দেখলে দেখা যাবে এটা সত্যিকারের জ্ঞানে পৌঁছার দাবি করলেও আসলে যেখানে গিয়ে পৌছায় তাকে দেরিদার ভাষায় লসোসেন্ট্রিসিজম বলা যায়। এর ক্রিটিক অনেক হয়েছে; কিন্তু দেরিদা দেখাচ্ছেন ‘মেটাফিজিক্স অব এপিয়ারেন্স’ বা হাজির হওয়া বিষয়ক ধোঁয়াশাচ্ছন্নতাকে আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারি নাই।
এই আলোচনা বিস্তারিত করতে হলে দেরিদার ভাষা দর্শন নিয়ে বিস্তারিত বলতে হবে। অল্পতে বলা যায়, ভাষা বা শব্দ যে তরিকাতে অর্থ প্রকাশ করে। হেগেলের আমলে আমরা দেখেছি, কোন শব্দের অর্থ তৈরির মূলে থাকে ছবি-কল্পনা ( পিকচার-থিংকিং) বিষয়ক আগাম ধারণা। যেমন: যখন কেউ ‘গরু’-শব্দটি উচ্চারণ করেন তখন গরুর একটা ছবি ধরেই তা করা হয় অথবা শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে কল্পনায় সেই বস্তুর ছবিটিও ভেসে উঠে। ফলে ব্যক্তি যখন শব্দ ব্যবহার করেন, সেই বিষয়ক ছবি শব্দ উচ্চারণের আগেই হাজির হয়ে যায় তার চিন্তায়। এরপরে এল, Ferdinand Saussure (1857-1913)-এর আবিষ্কার। তিনি দেখালেন, অর্থ উৎপাদন ও প্রকাশে কাজ করে ‘signifiers’ and the ‘signified’ সম্পর্কটি। মানে, একজন অন্যজনকে ‘অর্থ’ দান করছে; এবং এই ‘অর্থ’ একটা শব্দ দিয়ে প্রকাশ করার পরেও সেই শব্দকে বুঝতে আরও কিছু শব্দ-ই ব্যবহার করতে হচ্ছে। যেমন: চোখকে বুঝাতে গেলে নেত্র, আঁখি ইত্যাদি সমভাবাপন্ন আরও কিছু শব্দ ব্যবহার করতে হয়। দেরিদার ইন্টারভেনশনের আগে এটাকে একটা বিরাট আবিষ্কার হিসেবে দেখা হতো। দেরিদা ঠিক এই ধারণাকে উল্টিয়ে দিলেন। তিনি দেখালেন, এমন স্থির নির্ধারিত অর্থ উৎপাদনের বিপদ ও পদ্ধতিগত সমস্যা। তিনি আবিষ্কার করলেন ডিকন্সট্রক্ট পদ্ধতি। কে – কাকে – কি নামে ডাকবে বা কার – কি অর্থ উৎপাদন করবে – এর সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। যাকে ‘নামকরণের রাজনীতি’ বলে। যেমন: আপনি সরকারের বিরোধিতা করলে রাজাকার, দেশদ্রোহী খেতাব পাবেন। দেরিদা দেখালেন, যে যাকে এই ভাবে অর্থ দিচ্ছে এটা উল্টিয়ে দেয়া যায় বা ডিকন্সট্রক্ট করা যায়। এর ফলে অর্থ উৎপাদনের অথরিটি খর্ব হয়। ফলে পশ্চিম কেন দেরিদাকে ভয় পায় এবার আশা করি বুঝতে পারছেন যারাই অথরিটি হতে চান, নিজেদের সুবিধা মতো ইতিহাস ও সত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান তাদের জন্য দেরিদাকে হজম করা বিপদের।ফলে দেরিদা রাজনৈতিক ভাবে কতটা দরকারী তা আজও হয়তো আমরা বুঝতে পারি নাই। পারলে উনার চিন্তার গুরুত্ব আমরা মুখে না কাজেও করে দেখাতে চেষ্টা করতাম। আমি এইদিকগুলো বিবেচনায় নিয়েই দেরিদাকে এতোটা গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
তবে যুক্তরাষ্ট্রে একটা গ্রুপ দেরিদাকে খুব পছন্দ করতে শুরু করলেন সেই ১৯৬৫ সালের দিকেই। তারা দেখলেন, এই যে পদ্ধতি এতে তো একক অথরিটি সাজার সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। আবার দেরিদকে ধর্মনাশী বলেও অনেকে আখ্যায়িত করতে থাকলেন। কারণ ধর্ম গ্রন্থের অর্থ স্থির ও নির্ধারিত। কিন্তু দেখা গেল খোদ বাইবেলের চার প্রকার পাঠ পদ্ধতি রয়েছে এবং এতে অর্থও ভিন্ন ভিন্ন হয়। যাতে এমনকি কুরআনও একাধিক পাঠ পদ্ধতি নিজেই অনুমোদন করেছে; আর ব্যাখ্যার জগত তো অসীম। তাই বলা যায়, দেরিদার এই পদ্ধতি মোটেও ধর্ম বিরোধী নয়; বরং যারা নিজেদের সুবিধা মতো নিজেদের পাঠ, ব্যাখ্যাকে একমাত্র পাঠ বা সহি ব্যাখ্যা বলে দাবি করেন, নিজেদেরকে একমাত্র অথরিটি দাবি করেন ‘দেরিদার পদ্ধতি’ দিয়ে তাদের সেই একক দাবিকে উল্টে দেয়া যায়। ফলে দেখা যাচ্ছে যে কোন ধর্মমতের একশ্রেণীর পেশাদার বা ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাখ্যার অথরিটি খর্ব হওয়ার ভয়ে দেরিদার বিরুদ্ধে শুরু থেকেই প্রচার ছিল। অনেক নোংড়া প্রচারও ছিল। অথচ ধর্ম যে চিন্তা ও ব্যাখ্যার অসীম সম্ভাবনাকে স্বীকার করে তা ধর্মব্যবসায়ীরা মানতে চায় না। এরা অথরিটি সেজে বসে আছে। যে কোন অথরিটিকে পদ্ধতীগত ভাবে নাকানি-চুবানি খাওয়াইছেন দেরিদা।
এভাবে যে নতুন দিগন্ত আবিষ্কার হলো, এতে যে বিদ্যা শক্তিশালী হলো তাকে বলা যায় র্যাডিক্যাল হারমনিটিকস বা বিপ্লবী তাফসির বিদ্যা। অতি জটিল এই আলাপটি খুব সহজে বলা মুশকিল। এখানে জাস্ট নোট করে গেলাম।
আমি এদেশে এমন অনেক লোককে দেখেছি যিনি নিজেই নিজেকে পণ্ডিত ও দার্শনিক ঘোষণা করে দেরিদার নামে উনার চিন্তার ঠিক উল্টো জিনিস ডেলিভারি দিচ্ছেন, গর্ব ভরে; এবং কেউ এর কোন ক্রিটিকও করছেন না; বরং উল্টো সবাই বাহবা দিচ্ছেন! বাংলাদেশে চিন্তা চর্চার জটিলতার মূলে রয়েছে এইসব ছদ্মচিন্তকদের অথরিটি সেজে থাকা। এখন সময় এসেছে এসব ছদ্মচিন্তকদের মূর্খতাকে পূজা না করে সরাসরি সমালোচনার মধ্য দিয়ে নাকচ করে দেওয়া। কারণ এই ধরনের সফিস্ট বা ছদ্দচিন্তকরাই চিন্তার বিকাশের অন্তরায়।
যা হোক, হাইডেগারের পরে সবচেয়ে জটিল হলো দেরিদাকে পড়া/পাঠ করা। কখনও কখনও হাউডেগারের চেয়েও জটিল। কারণ লেখার মাধ্যমে লেখাকে নাকচ কারার যে দার্শনিক প্লে-ফুল পদ্ধতি দেরিদা আবিষ্কার করেছেন, যাকে খুব চলতি ও সহজে অনেকে ডিকনস্ট্রাকশন বলে চিনে থাকে, সেটা আসলে সঠিক না। দেরিদা ভীষণ আপত্তি করতেন, এই ধরনের সহজিকরণে। আরও একটি ধারণা দিয়ে দেরিদার চিন্তাকে বুঝতে পারা সম্ভব। এই বিচার করতে গিয়েই তিনি যে টার্মটা ব্যবহার করলেন তা হলো, ‘différance’/ ‘ডিফারেন্স। এই ধারণাকে তিনি গুরুত্ব দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন। একে তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছেন বিখ্যাত বই ডিসেমিনেশন-এ। অবশ্যই অন্য রচনাতেও এই বিষয়টা ফিরে ফিরে এসেছে। এটাকেই বুঝতে গিয়ে তিনি তার আলোচিত স্পিচ ও রাইটিং তত্ত্বটির অবতারণা করেন। এর কথা বলেই শেষ করবো।
এতদিন দেখা হতো, আমরা ‘যা বলি’ ( স্পিচ) তা হলো ভাষার আদি ও অরিজিনাল অংশ। ‘লেখা হলো’ বলার একটা রূপ বা দ্বিতীয় ধাপ, যা বিকৃতি আকারে এসেছে। দেরিদা দেখছেন, এই ধারণার মূল্যে দার্শনিক ফয়সালা নাই। কেবল ধরে নেয়ার ব্যাপার আছে। লেখাকে বিচার করার জন্য ফিরে যাওয়া হয় বচনের কাছে। এই যে একটার সাপেক্ষে অন্যটাকে বুঝার গলদ – তা তিনি পরিষ্কারভাবে হাজির করেন। জ্যাক দেরিদা প্লেটো, রুশো, সশ্যুর, লেভিস ত্রসের বই বিশ্লেষণ করে দেখান যে, ‘লেখার বিষয়’টাই এইসব রচনা তৈরি হওয়ার ক্ষেত্রে নিয়ামক বা মূল ভূমিকা পালন করেছে, স্পিচ বা বচন নয়। তিনি দেখাচ্ছেন, জগতের বিষয় আশয়ের মধ্যে ‘একটা লিখিত ব্যাপার’ মূলগতভাবে রয়েই গেছে; যা বচনেও পুরোপুরি ধরা যায় না। তিনি মূলত বলছেন, ভাষা ব্যপারটাই মূলত একটা লিখন প্রকল্প। যেটাকে তিনি ‘arche-writing’ টার্ম ব্যবহার করে বুঝাতে চেয়েছেন। বাংলাতে arche-writing-কে সহজে বুঝতে পারেন এমন একটা ধারণা হিসেবে যে, জগতের সব কিছুর মূলে একটা লিখিত আর্কি-টাইপ আছে। একটা বিরাট আর্কাইভ রয়েছে। যার পুরোটা বাচনে হাজির হয় নাই। ভাষা মূলত এই বিপুল বা গ্র্যান্ড লিখন প্রক্রিয়ারই একটি অংশ। (Language, in any form, is a kind of writing, Derrida calls “arche-writing”) ফলে আমরা যেহেতু এই লিখন প্রক্রিয়ার গ্র্যান্ড প্রকল্পটি বুঝতে পারি না ফলে আমাদের হাজির হওয়া, নিজেদের প্রকাশ করা একটা সারফেইস লেভেলের উৎকল্পনা মাত্র।
কারণ প্রকাশের মূল যে বিষয় তা arche-writing এর মধ্যে ধরা আছে। এটা আমরা বুঝতে বা উপলব্ধি করতেই পারি না। বরং আমরা বচন থেকে লিখায় আসার যে সহজ সূত্র ধরে নিয়েছি তাতে আমাদের হাজির হওয়া বা এপিয়ারেন্স ব্যাপারটাই সত্যের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে পড়েছে। ফলে এই আবিষ্কারে গোটা সাহিত্য প্রকল্প ও চিন্তার ধারা বিরাট হুমকিতে পড়ে গেছে। দেরিদার এই চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমি মোটেও অবাক হই নাই। দেরিদা ইহুদি হওয়ায় একশ্বরবাদের প্রকল্প বা মূসা (আ:)এর উপর নাজিল হওয়া কিতাবের বক্তব্য বিষয়ে জানতেন। এবং আমি একজন মুসলিম হিসেবে জানি কুরআনে পূর্ববর্তী সব কিতাবের সারাংশ হাজির করা হয়েছে; এবং বলা হয়েছে, জগতের সব কিছু লিখিত আছে। বিরাট এক লিখন প্রক্রিয়া চলমান আছে। যা ঘটছে বা ঘটবে সবই লিখিত আছে। যে কিতাব (কুরআন ও আগের নবীদের উপর নাজিল হওয়া কিতাব, যা দুনিয়াতে এসেছে তা লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত কিতাবের অংশ মাত্র)। দর্শনের এই arche-writing ব্যাপারটি কুরআনে বলা ‘সব কিছু লিখিত আছে’ এবং ‘ক্রমাগত লিখিত হচ্ছে’-এর সঙ্গে মিলে যায়।
অনেকে মনে করতে পারেন, মুসলমান হিসেবে এটা আমার উৎকল্পনা! তাদের জন্য আরও একটি বই থেকে উদাহরণ টানছি। এই একই রকম চিন্তার আভাস পাওয়ায় ইসলামের সঙ্গে দেরিদার চিন্তার মিল নিয়ে যে বক্তব্য দিচ্ছি সে বিষয়ে আমি আরও বেশি কনফিডেন্ট। বইটার নাম ‘গিফট অব ডেথ’। এখানে তিনি বলছেন,
what is a religion? Religion presumes access to the responsibility of a free self.
পশ্চিমা সেকুলার চিন্তার উল্টা কথা পাচ্ছি এখানে। ধর্ম মানুষকে মুক্ত করে। তার অন্তরকে সরল করে। পরের লাইনগুলোতে দেরিদা বলছেন, এই সেলফ মানে শুধু ব্যক্তি আমি না। বরং প্রাণী জগৎসহ অন্য সবার সঙ্গে মানুষের যে পরম সম্পর্ক তা স্বাধীনভাবে বুঝতে পারাই ধর্মকে সম্ভব করে তুলে। এটা একই সঙ্গে ব্যক্তির পবিত্রতার প্রশ্ন আবার সম্মিলিতভাবে একক স্বাধীন সত্তায় পরিণত হওয়ারও পথ। ইসলাম সরল ও মুক্তভাবে মানুষকে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এবং কোন মানুষের উপর মানুষের অথরিটি বহাল করার বিষয়টি নাকচ করে দিয়ে সরাসরি বান্দার সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্কের কথা বলেছে। আল্লাহ যাকে হেদায়েত দিতে চান তাকেই দেন। নবীরাও এই এখতিয়ার পান নাই। এবং এই সরলপথের মানুষগুলো একই সত্তা বা উম্মত হিসেবে পরিগণিত হবেন।
এখানে ইসলামের প্রস্তাবনার সঙ্গে দেরিদার চিন্তার মিল বুঝতে খুব বেশি পণ্ডিত হতে হয় না। এই লেখার মধ্য দিয়ে জাস্ট কিছু নোট রাখলাম। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য আরও সময় দরকার। সেই ইচ্ছেও আছে। (আগ্রহীরা দেখতে পারেন, এক্ট অব রিলিজিয়- দেরিদা, রাউটলেজ)
পুরো আধুনিক সভ্যতার গোড়াটাই সমস্যাজনক। দেরিদা বলছেন, এর ঐতিহাসিক সমস্যার বিষয়টিকে প্রথমে সমস্যা হিসেবে মেনে নিতে হবে। তারপরে গোড়া থেকে আমাদের প্রশ্ন তুলতে হবে। ‘গিফট অব ডেথ’ থেকে আরও একটি উদ্ধৃতি টেনে আজকের মতো শেষ করছি।
‘Modern civilization does not just suffer from its own faults, its own myopia, but also from failing to resolve the whole problem of history. But the problem of history cannot be resolved; it must remain a problem. The danger of the present time is that an excess of knowledge of detail might lead us to forget how to look at the question and the grounds that give rise to it.’
এই রূপ চিন্তার কারণেই পশ্চিমা দর্শনে দেরিদা একটি বিপ্লবী নাম। তাই তো তাকে আড়ালে রাখতে ডান-বাম মানে বাতিল হয়ে যাওয়া আধুনিকতার খাদেমদের এত আয়োজন, এত ভীতি। দেরিদাকে যত্রতত্র কোট করার জন্য না। চিন্তার এই বিপ্লবী ও সত্তার সত্য রূপকে বুঝতে চেষ্টা করার জন্য সারা জীবন উনার যে আকুতি তাই উনাকে মহৎ করেছে। আমাদেরও এই জন্য দেরিদাকে আরও বেশি দরকার এখন।
যেখান থেকে শুরু করেছিলাম তা দিয়েই শেষ করি,
আমরা এই যে হাজির হই, দৃষ্টিগোচর হতে চেষ্টা করি এটা মূলত এক ধরনের আত্মপ্রতারণা। আধুনিক মিডিয়া এই আত্মপ্রতারণার বাণিজ্যই করে চলেছে। আমি নিজে একজন সামান্য লেখক হিসেবে মৃত মানুষের মতো বাঁচতে চাই। এই হাজির হওয়ার আত্মপ্রতারণার ক্লান্তি থেকে রক্ষার্থে এছাড়া আর কোন পথ আমার জানা নাই। যেই হাজিরাতে আমার সত্তার সত্যসহ আমি উপস্থিত বা প্রকাশিত হতে পারি তার কোন মূল্য নাই। ফলে বিপুল লেখালেখি ও বিরাট সাহিত্যিক সেজে মিডিয়া গরম করে পুরস্কার নিয়েও আপনি এক সময় হারিয়ে যাবেন(!) যদি আপনি ও সত্য একাকার না হতে পারেন। এমনতাবস্থায় আপনার কোন সম্ভাবনা নাই। কারণ এই বিপুল আবর্জনার ভীড়ে একমাত্র সত্যই টিকে থাকবে শেষতক, আপনি বা আমি না।
ধর্ম ও দেরিদার চিন্তা নিয়ে বিস্তারিত লিখবার জন্য এখানে কেবল খসড়া আকারে নোট রাখা হয়েছে। এটা নিয়ে চিন্তা ও কাজ অব্যাহত থাকবে আগামীতে।
(প্রথম খসড়া: ২৫/৫/২০২০, ঈদুল ফিতরের ভোর।)