মানবাধিকারের প্রতি এখনও কিছু মানুষের আস্থা আছে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যখন আত্মপরিচয়ের ঝগড়া চলতে থাকে এবং মুসলমান পরিচয়টা সামনে চলে আসে তখন বিষয়টা আর একই রকম থাকে না। আর সকল মানুষের বেলায় মানবাধিকারের প্রশ্ন আর মুসলমানদের জিবনের বেলায় মানবাধিকার -এই দুইটা যে এক নয় তা বুঝতেও আমাদের সময় লেগে যায়। তবে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আমাদের সমাজ যেভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে তাতে এই বিষয়গুলো বুঝতে পণ্ডিত হতে হবে না। বাংলাদেশের তথাকথিত শিক্ষিত-প্রগতিশীলদের দিকে তাকালেই এটা চৈত্রমাসের দিনের মত ফকফকা হয়ে যাবে। আমাদের সমাজে সবকিছু নিয়ে বিভক্তি আছে, ফলে রোহিঙ্গা নিয়েও আমাদের সমাজ বিভক্ত। প্রচুর তথ্য-তত্ব বাদ দিয়ে চায়ের দোকানের সহজ আলাপের মত করে মোটা দাগে প্রাথমিকভাবে দুইটা পয়েন্ট ধরে কথা বলার চেষ্টা করছি….
এক.
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির নির্যাতনের ইতিহাস নতুন নয়। কয়েকদিন পর পরই তাদের উপর উলঙ্গ আক্রমণ চালানো হয়। তবে এখন চলছে গণহত্যার চুড়ান্ত অবস্থা। নারী শিশুসহ সবাইকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হচ্ছে। গুগল স্যাটেলাইট ম্যাপে দেখা গেছে প্রায় দেড় হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও কিছু বিদেশি মিডিয়ার বরাতে এই নির্যাতনের বিষয়ে যখন বিশ্বজনমত তৈরি হতে শুরু করে, যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেদের খাড়া করা মানবাধিকারের বৈশ্বিক বৈধতার সংকটজনিত কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কথা বলতে বাধ্য হয়, তখন মিয়ানমানের বৌদ্ধ সন্ত্রাসীগোষ্ঠি ও গণতান্ত্রিকভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা একযোগে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের সন্ত্রাসী ও জঙ্গি হিসেবে হাজির করে। এটা ভারত বাংলাদেশে ও পাকিস্তানে প্রায় কমন ঘটনা। কিছু লোক ধরে তাদের সামনে কিছু বই ও অস্ত্র রেখে মিডিয়ার সামনে ফটোসেশন করিয়ে নিজেদের জুলুমব্যবস্থাকে আরও মজবুত করার সুযোগ তৈরি করা হয়। দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই এটা একটা কমন প্রবণতা। এর সাথে গুলি করে হত্যার ঘটনা তো আছেই। এইসব হত্যার উদ্দেশ্যেই এমন নাটক প্রস্তুত করা হয় আসলে। যাহোক সাধারণ মানুষকে ‘জঙ্গি’ সাজিয়ে এইসব ঘটনা ঘটানোর মধ্য দিয়ে আসল ‘জঙ্গি’ যেমন আড়াল হয় অন্যদিকে এইসব সশস্ত্র গ্রুপগুলোর একটি স্থানীয় ভিত্তিও তৈরি হতে থাকে।
রোহিঙ্গাদের মধ্যে ১৯৫০ সাল থেকেই সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং বিভিন্ন সময় মিয়ানমার সরকারের সামরিক অভিযানের ফলে তা ভেঙেও যায়। তাই এতদিনেও শক্ত কোন সামরিক সংগঠন তৈরি হয়নি। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ধারায় যেসব সংগঠন কাজ শুরু করেছিল তাদের অবস্থা হল, আমাদের দেশের বামপন্থিদের মতো। এক একজন ব্যক্তি এক একটা পার্টি। সংগঠন তৈরি হতে দেরি আছে ভাঙতে দেরি নাই। এবং ঐসব সংগঠনের বেশির ভাগ নেতাই বিদেশি সাহায্য সংস্থার টাকা পয়সায় বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সেখানে বেশ আরাম আয়েশে জিবন যাপন করছেন। যেগুলো সক্রিয় আছে তা বৌদ্ধসন্ত্রাসী সংগঠন ‘৯৬৯’ এর কারণে সুবিধা করতে পারে না। এই সংগঠনের প্রধান অাশিন উরাথুকে টাইম ম্যাগাজিনের এক সংখ্যায় ‘বৌদ্ধ লাদেন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই নেতাকে নিয়ে যে কাভারস্টোরি ছাপা হয় সেটা দুনিয়ার সামনে নতুন এক বৌদ্ধ দর্শন হাজির করে। যারা জীব হত্যা মহাপাপ বলে মানলেও মহাসুখে মুসলমান হত্যা করে চলেছে। আমাদের দেশেরও একদল বুদ্ধিজিবিদের বৌদ্ধদের নাম শুনলেই দরদের চোখ টলটল করে ওঠে। এই অশিক্ষিত বুদ্ধিজিবিরা কখনও প্রশ্ন করে না বা খুঁজতে চেষ্টা করে না এই একবিংশ শতাব্দীতে যে কোন মতাদর্শ কিভাবে ভায়োলেন্ট রূপ নিয়ে হাজির হয়। বৌদ্ধ মতাদর্শকে যদি আমরা দার্শনিকভাবে বুঝতে পারি তাহলে এর ভিতর থেকে সন্ত্রাসের জন্ম কিভাবে সম্ভব তা বুঝতে কষ্ট হবে না। এটা নিয়ে হালের বিখ্যাত দার্শনিক স্লাভোক জিজেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন (দেখুন, ক্রিটিক অব বুদ্ধিজম-স্লাভোক জিজেক) আমি আগেই বলেছি তত্ব কথা বলব না। সো এই দিকে যাব না। বৌদ্ধ দর্শনের যে নিহিলিস্টিক এপ্রোচ, এরা যেভাবে নিখিল নাস্তির ভিতর দিয়ে মুক্তির চর্চা করে তার সাথে সেকুলার সন্ত্রাসবাদী চিন্তার অনেক মিল আছে। (মনে রাখতে হবে আমি সব বৌদ্ধদের বিষয়ে বলছি না, এই ধর্মের শান্তিবাদী অনুসারিরাও আছেন যারা আজও পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে জিবন কাটান) এবং এই সেকুলার আদর্শ বেশ পরিস্কার ভাবেই ইসলাম বিরোধি। সেই দিক থেকে বৌদ্ধসন্ত্রাসী ও আমাদের মূলধারার সেকুলার বুদ্ধিজিবিরা ভাই ভাই। এই আলোচনাও আমার মূল ফোকাস না। আমি এর চেয়ে কাজের পয়েন্ট ধরে কথা বলতে চাই, কেন সেকুলাররা এই অবৈধ ক্ষমতার বলে গদীনসীন সরকারকে একবারের জন্যও সীমান্ত ওপেন করে দিয়ে রোহিঙ্গা জনগনকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে দিচ্ছে না তার একটা বড় কারণ হল, ইসলামোফোবিক আচরণ। এটা সত্য, বৌদ্ধ সন্ত্রাসী ও সেই দেশের সেনা-পুলিশ মিলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর প্রায় অর্ধশত বছর ধরে যে ধরণের নির্যাতন চালাচ্ছে তা গ্লোবাল মুসলিম কমিউনিটিকে ব্যাপকভাবে মর্মাহত করছে। ৯/১১ এর পরে নতুন করে সাউথ এশিয়াতে কিছু গ্রুপের ‘জেহাদি’ মিডিয়ার ভাষায় ’জঙ্গি’ তৎপরতা শুরু হলে রোহিঙ্গা অঞ্চলেও কাজ শুরু হয়। কিন্তু যে কোন কারণেই হোক সেখানে এই ধরণের অস্ত্রধারী প্রতিরোধ শক্ত হতে পারে নি। দেখা গেছে সামান্য কিছু টাকা বা পুরস্কারের জন্য ঐখানকার স্থানীয় কিছু লোকজনই মুজাহিদিনদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে। মিয়ানমার বাহিনীর কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। সাধারণত যেসব অঞ্চলে মুসলমানরা মাইর খায় সেখানে কিছু কিছু অস্ত্রধারী গ্রুপ ফাংশন করে। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তেই এরা সক্রিয়ভাবে হাজির আছে। তবে অবশ্যই স্থানীয় জনগণের সমর্থন নিয়েই এরা টিকে থাকে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যা এত দিন লক্ষ করা যায়নি। তবে সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমের কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে ছোট ছোট গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। আর কিছু দল থাকে গণতান্ত্রিক লাইনে সমস্যা সমাধানের চেষ্টায়। আর এক দল থাকে অস্ত্রের লাইনে। এইসব গ্রুপের সাথে ‘গ্লোবাল জিহাদি’ সংগঠন আল কায়েদা ও অাফগান তালেবানদের যোগাযোগের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। তো এইখানেও এরা নানান সময় কাজের চেষ্টা করেছে এবং ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক লোকের জিবন দিতে হয়েছে কোন শক্ত প্রতিরোধশক্তি তৈরি হয়নি। তাইলে মনে করার কোন কারণ নাই রোহিঙ্গারা জঙ্গি। বরং জঙ্গি নয় বলেই নিরীহভাবে করুণ মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে এই দরিদ্র কমিউনিটির শিশু-নারী-পুরুষসহ সমস্ত মানুষ- এভাবেও দেখা যায়। কিন্তু আমাদের দেশের উগ্র সেকুলার পন্থিরা এই জঙ্গিজুজুর ভয়ে ভুলে গেছে মানবিক দায়িত্বের কথা। হঠাত করেই এই অবৈধ অনির্বাচিত কৌতুকপ্রিয় সরকারের ভক্ত হয়ে উঠেছে। আর রোহিঙ্গাদের পুশব্যাক করার সিদ্ধান্তে খুশি হচ্ছে। এটাকে দেশপ্রেম বলে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করছে। এই আচরণের গোড়া হল ইসলামোফোবিক মানসিকতা। রোহিঙ্গারা ধর্মযুদ্ধের শিকারে পরিণত হয়েছে।
ধর্মযুদ্ধের পরিসরে ‘বাঙালী মুসলমান’ ও ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’ উভয় পরিচয়ই কিছু সমস্যা তৈরি করে, রোহিঙ্গারা যেমন সবাই রোহিঙ্গা পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না তেমনি বাঙালীরা সবাই বাঙালী পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবে না। আত্মপরিচয়ের নির্মাণে ধর্মের ভূমিকাকে খাটো করে দেখার সেকুলার প্রবণতা এই সঙ্কটকে আরো উসকে দিচ্ছে
দুই.
রাষ্ট্র মানে এনজিও না। ফিলানথ্রোপিক কোন প্রকল্প না। যদিও বাংলাদেশের যেসব এনজিও রোহিঙ্গাদের নামে বিদেশ থেকে টাকা পয়সা আনে তাদেরকে নিষিদ্ধ করেছে সরকার। রাষ্ট্র মানে, কারো বাপ-দাদার স্বাধীন ইচ্ছার বালাখানাও না। প্রথম কথা হল রাষ্ট্রকে একটি মতাদর্শিক অবস্থান নিতে হয়। এই সেই মতাদর্শিক অবস্থানের প্রতি জনগণের ঐক্য সংগঠিত থাকতে হয়। তা না হলে রাষ্ট্র তার ক্ষমতাকে সংহত করতে পারে না বা জনগণের উপর তার আদেশকে আইনে পরিণত করতে পারে না। তারপরে সেই ভূখণ্ডের মানুষকে নিয়ে একটি ফাংশনাল ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়। সেই দিক থেকে বাংলাদেশ এখনও কোন রাষ্ট্র না। এটা একটা পিতৃপ্রজাতন্ত্র। অনেকে মজা করে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী গোপালগঞ্জ। ভোট ও জনগণের অধিকার কোন কিছুই দরকার নাই। নাগরিকদের মধ্যে সার্বভৌমত্বের মতো জরুরি বিষয়ে কোন চিন্তা নাই। রাষ্ট্র গঠন তো পরের কথা। খালি চেতনা দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে এরা মনে করেন। আর আমাদের দেশের অশিক্ষিত বুদ্ধিজিবিরাও এই নষ্টামিতে মজে গেছে। রোহিঙ্গা সমস্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, একটি সংগঠিত রাষ্ট্রকাঠামো কত জরুরি। এরা মনে করে কোন রকম ক্ষমতা নিয়ে পরিবারের ও দলীয় সন্ত্রাসীদের উন্নতি নিশ্চিত করতে পারলে আর লবিস্ট নিয়োগ করে কিছু পুরস্কার বাগায়ে মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার করতে পারলেই সফল নেতা-নেত্রী ও ক্ষমতাবান হওয়া গেল। আরও পরিস্কার করে বলি, অনেকে প্রস্তাব করছেন, যেহেতু মানবাধিকার একটি চুড়ান্ত প্রতারণা আকারে রোহিঙ্গা জিবনে হাজির হয়েছে তাই এই পথে সমাধান হবে না। আর বাংলাদেশেও যেহেতু ওদের আশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না তাই রোহিঙ্গা ভূমি আমাদের দখল করে নেয়া উচিত। দখল করে ওটাও বাংলাদেশের অংশ বানিয়ে ফেলা দরকার। সন্দেহ নাই, এটা অতি উৎকৃষ্ট কল্পনা। যা কোনদিনও সম্ভব না এবং উচিতও না। মিয়ানমারেও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি নাই। ১৯৮২ সালে নতুন নাগরিক আইন করার ফলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের ট্রিট করে ‘অনুপ্রবেশকারী ‘বাঙালি’ হিসেবে।
আরও একটি দিক এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয়, সাহিত্যগ্রস্ত এই জাতি আরাকানের রাজসভার সাহিত্য নিয়ে বেশ গর্ব করে থাকেন। এইসবকেও তারা নিজেদের সাহিত্যের ও সংষ্কৃতির অংশ মনে করেন বাট এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে কোন কথা নাই। এই বাঙালি সংষ্কৃতির ফাঁপা অহংটা এতো কুৎসিত যে এর গর্ভ থেকে তৈরি হয়েছে একটি ইমপোটেন্ট বা অক্ষম ফ্যাসিবাদ। হ্যাঁ বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদও অক্ষম। খালি তাইরে নাইরে করে ক্ষমতায় থাকার ধান্ধা। সাহস থাকে তো ঘোষণা দিয়ে বলুক আমরাই চির দিন ক্ষমতায় থাকব, না মানলে মেরে সাফ করে দিব। সেটা না বলে দেশের বারটা বাজিয়ে, মিথ্যা গল্প মিডিয়াতে প্রচার করে, কিছু জোকার নিয়ে খেলনা সংসদ ও মন্ত্রিসভা তৈরি করে, জনগণকে জিম্মি করে ক্ষমতায় টিকে আছে এই উম্মাদ কুশক্তিটি। আর এর জন্য ব্যবহার করছে অনুগত কিছু সংষ্কৃতি ব্যক্তিত্ব নামধারি সুশীল সন্ত্রাসী। তাই এটাকে বলা চলে সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদ। নিজের দেশের মানুষের সাথে এর কোন সংযোগ নাই। বন্ধুদ্বের নামে সব দেশের মনজুগিয়ে চলার নীতিই এরা নিতে বাধ্য, নিয়েছেও তাই। কোন দেশের সভরেন্টির কোন বোধ এদের নাই। ফলে এদের পক্ষে বাইরের কোন দেশের সাথে কোন ইস্যু নিয়ে টেক্কা দেওয়া সম্ভব না।
আরও একটি কথা পরিস্কার বলতে হবে, ধর্মযুদ্ধের পরিসরে ‘বাঙলা মুসলমান’ ও ‘রোহিঙ্গা মুসলমান’ উভয় পরিচয়ই কিছু সমস্যা তৈরি করে, রোহিঙ্গারা যেমন সবাই রোহিঙ্গা পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় না, তেমনি বাঙালী সবাই বাঙলী পরিচয়ে পরিচিত হতে চাইবে না। আত্মপরিচয়ের নির্মাণে ধর্মের ভূমিকা খাটো করে দেখার সেকুলার প্রবণতা এই সংকটকে আরো উসকে দিচ্ছে। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের জোর করে বাঙালী বানানোর কিছু নাই। ভাষাভিত্তিক বা ভৌগলিক পরিচয় ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে আজকের দুনিয়ায়। গ্লোবাল পরিসরে বিশেষ করে ‘ওয়ার অন টেরর’ এর যুগে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে যেভাবে মানুষের পরিচয়কে নির্মাণ করা হচ্ছে তাতে বরং মজলুম নিজ নিজ নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের চেয়ে তার ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের দিকে বেশি করে মনযোগ ফেরাবে। বিশেষ করে যখন ধর্মের ভিতর বৃহত্তর উম্মাহর প্রশ্ন ও এই উম্মাহকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে কিছু কিছু গ্রুপ সশস্ত্রভাবে সক্রিয় আছে। এরা যদি মজলুমের দিকে হাতবাড়িয়ে দেয় তখন বিশ্বাস সশস্ত্র মতাদর্শ হিসেবে একটি জনগোষ্ঠির মধ্যে বিস্তার লাভ করে। এভাবেই জাতীয় মুক্তির লড়াই অনেক দেশেই এখন জেহাদের রূপ নিয়েছে। মিয়ানমার তথা আরাকান, পাকিস্তান, লিবিয়া, তিউনিশিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়াসহ সব দেশেই একই বাস্তবতা বিরাজ করছে। অনেকে মনে করতে পারেন আমি মনে হয় ধর্মের পরিচয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছি। নাহ, সমাজবিজ্ঞানের একজন ছাত্র হিসেবে এখনকার বাস্তবতা ধরেই কথাটা বলছি। দেখবেন, নানান জাতি, সংষ্কৃতি ও ধর্মের সমন্নয়ে চলার ওয়াদা যারা করেছে যেমন আমেরিকা বা ইউরোপ, ‘জঙ্গি’ হামলার কারণে সেইসব দেশের শান্তিপ্রিয় মুসলমানদের উপর বিরূপ আচরণ হলে, নাগরিকরা প্রতিবাদ করেন। ব্যানারে লেখা থাকে, ‘আই এম মুসলিম, আই এম নট এ টেরোরিস্ট’। তার মানে সে তার মুসলিম পরিচয়টাকে বাদ দিয়েই নিরাপদ থাকতে চায় না, সে শুধু জানান দিতে চায় সে সন্ত্রাসী না। বিখ্যাত চিন্তক সাবা মাহমুদ লিখেছেন, ‘পলিটিকস অব পায়িটি’ নামের এক জরুরী থিসিস। এই যুগে ধর্ম-চিহ্ন বা পরিচয় থেকেই রাজনীতি ঠিক করা হয়।
অনেকে একাত্তরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার উদাহরণ দিয়ে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কথা বলছেন। মনে রাখতে হবে, এই দুই বাস্তবতা এক নয়। আমাদেরটা ছিল জাতীয় মুক্তির আন্দোলন। আর মিয়ানমারে যেটা চলছে সেটা মুসলিম নিধন, বৌদ্ধ-সন্ত্রাসীদের তরফে চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধ। ‘জঙ্গি বৌদ্ধরা ওদের ধর্মের জায়গা থেকেও মুসলমানদেরকে শত্রু বলে সাবস্ত্য করেছে। খেয়াল করলে দেখবেন, খ্রিস্টানসহ অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উপর মিয়ানমার সরকারের বা বৌদ্ধসন্ত্রাসীদের আচরণ এমন ভয়াবহ নয়। এই ধরনের আক্রমণ চোখে পড়ে না। ‘বৌদ্ধ লাদেন’ খ্যাত উইরাথু প্রকাশ্যে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ন্যক্কারজনক ভাষায় শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অন্যদিকে যারা বলছেন, বাংলাদেশ দরিদ্র, আমাদের নিজেদের নানান সমস্যা রয়েছে, আমরা আশ্রয় দেওয়ার সক্ষমতা রাখি না, তারা হয়তো জানেন না পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি শরণার্থী যেসব দেশে রয়েছে সেগুলোর একটাও তথাকথিত উন্নত রাষ্ট্র নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে নিজের ঘর-দরজা ঠিক না হলে আমরা পরের ঘরের আগুন নেভাতে পারব না।
যারা মনে করছেন অং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরষ্কার ফিরায়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তারা ফেসবুকের কল্পজগতে বাস করেন। এথনিক, ধর্ম ও বিশ্বাসের রাজনীতি আরও গভীর ও জটিল। সেই দিকগুলো মাথায় রাখতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ভিতর থেকে সন্ত্রাসবাদী প্রতিরোধই ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠবে। আর আমাদের রাষ্ট্রের অক্ষমতা লুকানোর জন্য যে মুক্তিযুদ্ধের কচকচানি তা উভয় সীমান্তে মাইর খাইতে খাইতে আপনাকেও শরণার্থী বানায়ে দিতে পারে। সার্বভৌমত্বের বোধ যার নাই সে নির্বোধ
আজকে রোহিঙ্গাদের অবস্থা দেখে আমাদের বুঝতে পারা উচিত একটি গণতান্ত্রিক ও জনগণের তরফে বৈধ ক্ষমতার কতটা দরকার। যদি আামাদের রাষ্ট্র একটি সংহত অবস্থানে থাকত। আমরা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে পারতাম। ঐখানে রোহিঙ্গা জাতীয় মুক্তির আন্দোলন নিয়ে অনেকগুলো রাজনৈতিক সংগঠন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ৫০ বছর ধরে। এইসব সংগঠন রোহিঙ্গা জাতীয়তাবাদি রাজনীতির বিকাশ চান। আলাদা শাসন কাঠামো চান। বৌদ্ধসন্ত্রাসীদের নির্যাতন থেকে এই জনগোষ্ঠি বাঁচার জন্য যারা জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম করছে তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করে একটি স্বাধীন কাঠামোতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে (প্রায় ১৬ লাখ মানুষ) বসবাসের সুযোগ করে দেওয়াই প্রতিবেশি হিসেবে আমাদের জন্য কাজের কাজ হত। দখল করে মাস্তানি দেখানোর কিছু নাই। আর সেই সামর্থ্যও বাংলাদেশের নাই। একটি অক্ষম রাষ্ট্রের কাছে নিজের জাতভাইদের জন্য সাহায্য চাওয়ার কোন মানে হয় না। এরা তো জাতও চিনে না। এরা ভুলে গেছে ওরাও একই সাহিত্য ও সংষ্কৃতির অংশীদার। আামাদের মধ্যযুগের সাহিত্য ওদেরই সৃষ্টি। কিন্তু আজ ইসলামোফোবিক সেকুলার বুদ্ধিজিবি এই সাংষ্কৃতিক পরিচয়কে ভুলে গেছে রোহিঙ্গাদের মুসলমান পরিচয়ের কারণেই। মনে করেন, ওখানে যদি পশ্চিমবঙ্গের প্রমিত কথা বলা, রবীন্দ্রসঙ্গীত ওয়ালা বাঙালী এমন নির্যাতনের শিকার হতো তাহলে আনিসুজ্জামান ও শাহরিয়ার কবিররা কি করত? ফলে এইসব কুলাঙ্গারদের কাছ থেকে সমর্থন প্রত্যাশা না করে, এই সকল বিষয়ে তথাকথিত সেকুলার ও শাহবাগের পরাজিত শক্তির পজিশন দেখে নিজেদের শত্রু-মিত্র দ্রুত চিনে নেয়াই হবে আসল কাজ।
আমাদের দেশে জাতিসংঘের তত্বাবধানে বিশাল আশ্রয় শিবির রয়েছে এতে দেশ রসাতলে যায় নাই। নাফ নদী দিয়ে ইয়াবার চালান আসলে সমস্যা হয় না, প্রাণ ভয়ে মানুষ আসলে নিরাপত্তা নষ্ট হয়? ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়া রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে সম্মতি জানিয়েছে। যাই হোক এই জুলুম যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে ধর্মযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় তখন বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজিয়ে আরামে দিন কাটাতে পারবে না। এই যুদ্ধ ছড়ায়। আর আমাদের দেশেও ইতিমধ্যে এটা ছড়িয়ে রয়েছে। কাজেই নিজেদের দিকে ফিরে নাগরিকদের এটা ভেবে লজ্জা হওয়া উচিত যে, আমরা একটি অক্ষম ও রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া রাষ্ট্রের নাগরিক। আলজাজিরা টেলিভিশনেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে যখন প্রশ্ন করা হয় প্রাণভয়ে জিবন বাঁচাতে যেসব রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে চেয়েছে বিজিবি তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে কখনো কখনো বলপ্রয়োগ করে পুশব্যাক করেছে। জবাবে তিনি বলেন, “না না তারা খুব মানবিক আচরণ করা হয়েছে, খাবার, ওষুধ ও টাকা দিয়ে তাদেরকে মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো হয়েছে”। এর পরে আরেকটি প্রশ্নে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অক্ষমতাকে তিনি পরিষ্কার করেছেন। যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গাদের প্রতি আচরণ নিয়ে তিনি কোন প্রশ্ন তুলেছেন কিনা। হাসিমুখে তিনি বলেন, ‘‘মিয়ানমার সরকার তাদের দায়িত্ব পালন করছে, এবং এই দায়িত্ব ঠিকভাবেই পালন করছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন’’। এই জেনোসাইডকে তিনি অস্বীকার করে সন্ত্রাসী মিয়ানমার সরকারের অাচরণকে লজ্জাহীনভাবে সমথন করেন। এইসব নিষ্ঠুর কৌতুকে কান না দিয়ে সবকিছু বুঝেশুনে নিজেদের দায়িত্ব নিজেরা বুঝতে পারলে আমাদের চলমান গণতান্ত্রিক লড়াইটাও শাণিত করা যাবে।
শেষ করি, রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপ্রিয় সমাধানের পথ খুব একটা পরিষ্কার না। আপনারা যারা মনে করছেন অং সান সুচির নোবেল শান্তি পুরষ্কার ফিরায়ে নিলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে তারা ফেসবুকের কল্পজগতে বাস করেন। এথনিক, ধর্ম ও বিশ্বাসের রাজনীতি আরও গভীর ও জটিল। সেই দিকগুলো মাথায় রাখতে হবে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ভিতর থেকে সন্ত্রাসবাদী প্রতিরোধই ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠবে। আর আমাদের রাষ্ট্রের অক্ষমতা লুকানোর জন্য যে মুক্তিযুদ্ধের কচকচানি তা উভয় সীমান্তে মাইর খাইতে খাইতে আপনাকেও শরণার্থী বানায়ে দিতে পারে। সার্বভৌমত্বের বোধ যার নাই সে নির্বোধ। যদি মুসলমানও বলেন তাও রোহিঙ্গারা আমাদের কওমের অংশ যদি বাঙালিও বলেন তাও ওরা আমাদেরই লোক। কিন্তু দেখেন আমাদের নিজেদের দেশেই আত্ম-পরিচয়ের এই রাজনীতির কোন মিমাংসা হয় নাই। একটা গোঁজামিলের ভিতর দিয়ে পরিচালিত দেশের তথাকথিত আধুনিক ও শিক্ষিত-প্রগতিশীল শ্রেণী রাষ্ট্রের এই অক্ষমতা আড়াল করতে রোহিঙ্গাদের সাথে নিজেদের সম্পর্ককে অস্বীকার করে চলেছে। এই জন্য নানান রকম জাল ইতিহাস ও নৃতত্ব হাজির করে পণ্ডিতি করতেছে। আমি ইচ্ছে করেই এই লেখায় জটিল আলাপের দিকে গেলাম না। কেবল বলতে পারি আপনি অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হবে না।