বয়স ৮৫ বছর পূর্ন হলো আজ। যুক্তি, বিজ্ঞান এমনি কি বিশ্বাসের নামেও প্রতারণা দেখে দেখে এখন শরীর-মন সবই ক্লান্ত। জীবনের প্রতি আগ্রহ চারপাশের অবহেলায় ক্রমে ক্ষীন হয়ে আসছে। মৃত্যুই সবচেয়ে নিকটে কিন্তু কবে কে পৌঁছাবে তার কাছে – সেটা আগাম কেউ জানে না।
সব অবহেলা ভুলে থাকার মতো প্রবল জোছনায় চারপাশ ভেসে যাচ্ছে আজকে। বয়সী অবসাদের ভারেও ঘুম আসছে না এই মধ্যরাতেও। চারপাশে তাকায়ে থেকেও জোছনার সৌরভে মন ভরে না। তাকাতে হয়- আকাশের দিকে। তা হলেই আসল স্বাদ পাওয়া যায়। আকাশের দিকে তাকালেই জোছনার রহস্য খুলতে থাকে ধীরে ধীরে।
৮৫ বছরের বৃদ্ধ একধ্যানে জোছনা ঝরা চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। বয়সী ক্লান্তি আর মোলায়েম আলো মনে হয় একই রকম ছন্দে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ছে।
প্রচণ্ড প্রাণময় এক তরুণী এবং তার চেয়ে চঞ্চল এক তরুণ পাশের দুটি পাশা-পাশি বাড়িতে থাকেন। তাদের প্রাণ কি চায় তারাও ঠিক জানে না। তবে আজ রাতের জোছনা তরুণ-তরুণী এবং ৮৫ বছরে পৌঁছানো বৃদ্ধ -এই ত্রয়ীকে মাতাল করেছে। ঘুম কেড়ে নিয়েছে।
জোছনার জোয়ারে বৃদ্ধের হাহাকার জেগে ওঠে। যৌবনে এমন ভাবে জোছনা দেখার অবসর হয় নাই। অথবা বলা যায় চারপাশে বাস্তব দৌড়ের বাইরে মাঝ রাতের জোছনার সাথে নিজের সংযোগ তৈরি জন্য যে ধীর ও শান্ত ভাবে আকাশের দিকে তাকানো দরকার তার সুযোগ হয় নাই। চোখ মেলে তো দেখাই হয়, কিন্তু সেই দেখার সাথে নিজের একান্ত অস্তিত্ত্বের বোঝাপড়ার অবসর হয় না মানুষের। যদিও বৃদ্ধ সময়ের জোছনার বান মনকেও বেশি দূর ভাসায়ে নিতে পারে না। কেমন এক অসহ্য, অব্যক্ত কষ্ট আরও ক্লান্ত করে বৃদ্ধকে। ৮৫ বছর বয়সে এমন মাঝরাতে জোছনার -এই রুপ আবিস্কার করে যেন মনোবেদনা আরও গাঢ় হলো।
বাড়ির ছাদে আধশোয়া চেয়ারে বসা বৃদ্ধের সাথে জোছনার এই ছল ছল কষ্ট-ছলা দেখতে দেখতে তরুণীর চোখে পানি আসে। ধুয়ে যায় কাজল। সে জোছনা ঝরা চাঁদকে নয়, আজ দেখছে, একমনে জোছনা দেখা ৮৫ বছরের বৃদ্ধকে। শেষ সময়ে সবচেয়ে আগে যে জিনিসটি রপ্ত করতে হয় তা হলো- অবহেলার সাথে অভ্যস্ততা। তখন বরং কেউ বেশি মনযোগ দিলেই অবাক লাগে। অবহেলাটাই স্বাভাবিক মনে হয়। এমনই এক বৃদ্ধের জোছনায় নাওয়া দেখতে দেখতে চোখের পানিতে নিজের সুখকে ভিজিয়ে নিতে থাকেন তরুণী। কিন্তু কি সেই কষ্ট তা নিজের কাছেও অজানা থেকে যায়, তবে এই কষ্টের চাপ সামাল দেয়ার শক্তি থাকে না তার। এমন অবস্থায় কান্নার চেয়ে বিশ্বস্ত আশ্রয় আর হয় না। তরুণের আনাড়ি কন্ঠের একটা গানও কানে আসে। গানটার সুর চঞ্চলা হলেও আজ সুরটাকে খুব বিষণ্ণ মনে হয়।
প্রবল জোছনার স্রোতে চারপাশের সব সবুজে জোছনার জোয়ার ছড়িয়ে পড়ছে যেন। বিষন্নতা ছাড়া কোন সৌন্দর্যর প্রকৃত প্রকৃতি ধরা দেয় না। তাই কান্নার পরে রিদয় ও মন আরও শান্ত হয়। মানুষকে তখন আরও বেশি সুন্দর মনে হয় নিজের কাছে। এই সৌন্দর্য্য নির্ভার জনিত। বৃষ্টিহীন আষাঢ়ের মধ্যরাতে মনে হচ্ছে, জীবনের সব বিষন্নতা যেন মিশে আছে জোছনার আলোর সাথে এবং শোকের কাপড়ের মতো ধব ধবে জোছনায় ভাসছে চারপাশ। একটা অব্যক্ত, ভাষাতীত কষ্ট জাগছে কিন্তু এই কষ্টেরও আছে অপরুপ এক রুপ।